গত মে মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পাকিস্তানিদের একটা দল ইসরায়েল সফর করেছে। এ সফরের মূল আয়োজক ছিল ‘শারাকা’ নামের একটা গ্রুপ, যারা ২০২০ সাল থেকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাক্ষরিত ‘আব্রাহাম একর্ড’- এর উপর ভিত্তি করে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পেছনে কাজ করছে।
পাকিস্তানি পত্রিকা ‘দ্য নিউজ’-এর মতে, পাকিস্তানিদের ওই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান লবির সদস্য আনীলা আলী। আর এই গ্রুপের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক আহমেদ কুরাইশি, যিনি সরকারি পাকিস্তান টেলিভিশনের একজন টক-শো সঞ্চালক। ‘জিও টিভি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আনীলা আলী বলেন, তাদের সফরের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই; বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্কোন্নয়ন।
‘এনপিআর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে, পাকিস্তানের পাসপোর্টে এখনো ইসরায়েল ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। যারা ইসরায়েল গিয়েছেন, তারা মার্কিন পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটার আয়োজক ছিল মার্কিন মুসলিম মহিলাদের একটা সংস্থা। এই সফর ইসরায়েলে খুব একটা আলোচিত না হলেও পাকিস্তানে এ নিয়ে তুমুল ঝড় বইছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগে অনেকেই ধারণা করেছেন যে, সৌদিদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে চলেছে। যদিও পাকিস্তান সৌদি আরব দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত। তথাপি পাকিস্তান হয়তো সৌদিদের পথে হাঁটতে পারবে না।
পাকিস্তানি সাংবাদিক কুনওয়ার খুলদুনে শহীদ ইসরায়েলের ‘হারেতস’ পত্রিকার এক লেখায় বলেছেন, সৌদি আরবের কারণেই ইসরায়েলের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ হয়তো অবশ্যম্ভাবী। তিনি মনে করছেন যে, সৌদি আরবের পর সুন্নি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শেষ বাধা হিসেবে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্ত জাতীয়তাবাদীরাও এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষপাতী।
ইসরায়েল সফরকারী আহমেদ কুরাইশিকে এখন পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মধ্যেই অনেকে সমর্থন দিচ্ছেন। পাকিস্তানের পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা এবং কৃষিবিদদের কেউ কেউ এখন বলছেন, ইসরায়েলের কাছ থেকে পাকিস্তান প্রযুক্তি নিয়ে নিজেদের পরিবেশ এবং কৃষির উন্নয়ন করতে পারে। মাত্র এক দশক আগেও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা পাকিস্তানে করা যেত না। সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিই পাকিস্তানকে এই পথে হাঁটাচ্ছে। তবে তার ধারণা যে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গেলে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, সে ব্যাপারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা মনে করছেন যে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে গেলে তারা জনগণের যে আক্রোশের শিকার হবে, সেটাকে সেনাবাহিনী যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবেই কাজটা করা সম্ভব। রাজনীতিবিদরা নিরাপত্তা চাচ্ছেন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে; আর সেনাবাহিনী নিরাপত্তা চাচ্ছে ওয়াশিংটন এবং রিয়াদের কাছ থেকে। খুলদুনে শহীদ বলেছেন, খুব শিগগিরই হয়তো পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘আইএমএফ’-এর ঋণের মতো সুন্দর কিছু প্রস্তাব দেওয়া হবে; যেগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তাবও থাকবে। এছাড়াও সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে সৌদি আর্থিক সহায়তায় আমদানি করা গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের উপর ভর্তুকির ঘোষণা এবং পবিত্র আল আকসা মসজিদে যেতে দেওয়ার দাবি হয়তো আসতে থাকবে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, তার উত্তরসূরিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং কাশ্মীরের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে। খুলদুনে শহীদ বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে ইমরান খানকেও এই একই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল; যিনি তা করতে পারেননি। ইমরানের কথাগুলোকে মোকাবেলা করতে ২ জুন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ‘জেরুজালেম আমাদের’ এই স্লোগান লেখা স্কার্ফ গলায় জড়িয়ে পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা মারইয়াম নাওয়াজ বলেছেন, জেমাইমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করে পাকিস্তানে শুধু ইমরান খানই ইহুদিদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক করেছেন। আর ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট’ দলের নেতা ফজলুর রহমান, যিনি এতকাল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে খুবই সরব ছিলেন, তিনি এখন বলেছেন, ইমরান খানই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এগোচ্ছিলেন। ২০২১ সালের জুনে ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী রাজনীতিবিদ বিলাওয়াল ভুট্টো অভিযোগ করেন যে, ইমরান সরকারের দুজন উপদেষ্টা গোপনে ইসরায়েল সফর করে এসেছেন।
এক টুইটার বার্তায় আহমেদ কুরাইশি বলেছেন, ইমরানের দলের শিরীন মাজারি, যিনি এখন ইসরায়েলের বিপক্ষে কথা বলছেন, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থিংকট্যাংক ‘আইএসএসআই’-এর প্রধান থাকার সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি তুরস্কে গিয়ে পাকিস্তানের পণ্যের ইসরায়েলে সহজে ঢোকা নিশ্চিত করতে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলভান শালমের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন; অথচ তখন শিরীন মাজারি কোনো প্রতিবাদই করেননি। ‘দ্য ডন’ পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আহমেদ কুরাইশি বলেন, শেহবাজ শরীফের সরকার যখন বলছে যে, সরকার তাকে পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে বরখাস্ত করেছে, তখন বোঝা যায় যে, তারা ইমরানের অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে একই নীতিতে হাঁটছেন।
পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা ইসলাম নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে চিন্তার কেন্দ্রে রাখছেন। আহমেদ কুরাইশি বলেছেন, পাকিস্তান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে কিনা, সেটা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। তিনি আরও বলেছেন, যখন ইসরায়েল কোনো আলোচনাতেই ছিল না, তখন ইমরান খানই হঠাৎ করে পাকিস্তান ইসরায়েলের সম্পর্কের ব্যাপারটা তুলে এনেছেন; যা কিনা এই বিষয়টাকে খোলা আলোচনায় নিয়ে এসেছে। পুরো ব্যাপারটার একটা ধারণা পাওয়া যায় ‘মনপিআর’-এর প্রশ্নে ইমরানের সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর উত্তরে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানিদের ইসরায়েল সফরে তাদের সরকার অনুমতি দিয়েছিল কিনা, এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তাদের নীতি হলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা। খুলদুনে শহীদ বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছেন বলেই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের পক্ষে পাকিস্তানের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন