টাঙ্গাইলে যমুনার চরে এক সময় আবাদ হতো ধানসহ অন্যান্য ফসল। নব্বইয়ের দশকে নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় চরের অধিকাংশ ফসলি জমি। বাঁধ নির্মাণের ফলে যমুনার ভাঙন অনেকটাই কমেছে। দুই বছর আগে আবারও জেগে উঠেছে চর। তবে আবাদি জমি ফিরে পেলেও ধান চাষে ফিরে যাননি চরাঞ্চলের কৃষক।
বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, জাপান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি, বেঙ্গল টোব্যাকো কোম্পানি, গ্লোবাল টোব্যাকো কোম্পানি, তারা টোব্যাকো কোম্পানি তাদের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে টাঙ্গাইলের স্থানীয় কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে।
চাষ পূর্ববতী ও পরবর্তী বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকে এসব বহুজাতিক কোম্পানি। তামাক চাষে বীজ ও সার ক্রয়ের জন্য নগদ টাকাসহ নানান উপকরণ সরবরাহ ও নিয়মিত তদারকি করে কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এসব সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি জেনেও দিন দিন তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষীরা। একই সঙ্গে বিকল্প ফসল উৎপাদনে খরচ বেশি ও ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা না থাকায় তামাক চাষে আগ্রহ বাড়ছে অনেক কৃষকের।
“ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫, (২০১৩ সালের সংশোধনী)” প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ধারা ১২-তে তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করবার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করতে পারবে বলেও উল্লেখ থাকলেও সরকারের পক্ষে থেকে মাঠে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা মিলে না।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, নলশা, জগৎপুরা, বামনহাটা, চর নিকলা, নিকরাইল, পালিমা, আমুলা, কালিহাতী উপজেলার সল্লা, দেউপুর, চর হামজানী, কদিম হামজানী, পটল, বেরী পটল, জোকারচর, গোহালিয়াবাড়ী, কুর্শাবেনু, সলিল গোবিন্দপুর, আফজালপুর ধলাটেঙ্গর, টাঙ্গাইল সদরের কাকুয়া, হুগড়া, কাতুলী, মামুদ নগর, চর পৌলী, দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, নাগরপুরের পাকুটিয়া, ভাদ্রা, বেকরা, আটাপাড়া, সলিমাবাদ, ধুবুরিয়া, মোকনা, বনগ্রাম, শাহজানী প্রভৃতি অঞ্চলে দিগন্তজুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে।
টাঙ্গাইল জেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হচ্ছে কালিহাতি ও ভূঞাপুর উপজেলায়। শুধু এ চরাঞ্চালের গ্রামগুলোতেই কয়েক হাজার একর ফসলি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা।
কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, তামাক উৎপাদনে কোম্পানির তৎপরতা, বিক্রির নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ তামাক চাষের প্রধান কারণ। তামাক কোম্পানির তৎপরতা বন্ধ না হলে দিন দিন লোভের কারণে কৃষকরা তামাক চাষে আরও বেশি ঝুঁকে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলায় পাঁচটি উপজেলায় এবার ২৩৩ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ভুঞাপুরে ১১৫ হেক্টর, কালিহাতীতে ৯০ হেক্টর, নাগরপুরে ৭ হেক্টর, দেলদুয়ারে ৩ হেক্টর ও সদর উপজেলায় ১৮ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মৈশানন্দলাল গ্রামের রহিম, মিজান, খোকন ও ছবুর চারজনে মিলে ১১০ বিঘা অর্থাৎ তিন হাজার ৬৩০ শতাংশ জমিতে তামাক চাষ করেছেন। ব্রিটিশ টোব্যাকো কোম্পানি তাদের জমির প্রক্রিয়াকরণ, সার বীজের জন্য ঋণ দিয়েছেন প্রায় ৩ লাখ টাকা। জিংক, দস্তা, ছত্রাক নাশক, ডিএপি, ফসফেট সার দেওয়ার জন্য আলাদা করে লোন দেওয়া হয়। প্রতিবিঘা জমিতে উৎপাদন খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় লাভ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। ১১০ বিঘা জমিতে তাদের সম্ভাব্য লাভ হবে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষ করে এত টাকা লাভ করা সম্ভব নয় বলে জানান কৃষকরা।
হুগড়া ইউনিয়নের আজহার আলী তার চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। কোম্পানি থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। তবে এবার উৎপাদন ভালো হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদন ভালো হয় নাই। তারপরেও ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ থাকবে বলে তিনি জানান।
কালিহাতি উপজেলার সলিল গোবিন্দপুর গ্রামের হাসানুল বলেন, এই গোবিন্দপুর গ্রামে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। আমি নিজেই ১০ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। প্রতি কেজি ২০৫ টাকা ধরে, বাজার ভালো থাকলে ৮ হাজার টাকা মণ দাম পাব। আমার খরচ হয়েছে ২ লক্ষ টাকা, সব মিলিয়ে আমি তামাক বিক্রি করবো ১০ লক্ষ টাকা। কোম্পানি গাড়ি দিয়ে এসে মাল নিয়ে যাবে আর সরাসরি ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। সবকিছুই করে দেয় কোম্পানির লোকেরা।
ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির সলিল গোবিন্দপুর, কুর্শাবেণু এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠকর্মী জিয়া বলেন, “কত জায়গায় তামাক চাষ হচ্ছে এটা বলতে পারবো না। তবে এখানে ৬টি টোব্যাকো কোম্পানি কাজ করে।”
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রির্সোস ম্যানেজমেন্ট (ইসআরএম) বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, “তামাক সেবন যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি এই ক্ষতিকর দ্রব্য উৎপাদনে আমাদের কৃষি জমি, বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে যা পরিবেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যে জমিতে তামাক চাষ করা হয় সেখানকার উপকারী পোকা মাকড়, অণুজীব ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তামাক থেকে উৎপাদিত পণ্য বিড়ি, সিগারেটের অব্যবহৃত অংশ মাটি, পানি, বায়ুকে দূষিত করছে এবং এর বিষ খাদ্যচক্রে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া তামাকের নিকোটিন ফুসফুসে ক্যান্সারসহ মানব শরীরে নানা রোগের সৃষ্টি করে।”
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আশেক পারভেজ বলেন, “কোম্পানির লোভের ফাঁদে পা দিয়ে অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষ করছে। জমির উর্বরতা নষ্ট ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি জানিয়ে কৃষকদের মাঝে সচেতনতাবিষয়ক সভা ও তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। কৃষিখাতে যে সকল প্রণোদনা রয়েছে সেগুলো কৃষকদের নিয়মিত প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”