গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় দফা সংলাপের উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে এনে জুলাই সনদ ঘোষণা করা সম্ভব হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি সারা দিনে যত মিটিং করি, এ পর্যন্ত যত মিটিং করে এসেছি, সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই যখন আপনাদের সঙ্গে বসার সুযোগ পাই, আলাপ করার সুযোগ পাই। কারণ এখানে সবাই মিলে বাংলাদেশের প্রকৃত ভবিষ্যৎ রচনা করা হচ্ছে। এটা আমাকে শিহরণ জাগায় যে এ রকম একটা কাজে আমি জড়িত হতে পেরেছি, নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি।
সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে বিএনপি জুলাই সনদ ঘোষণার পর ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব বলে যুক্তি তুলে ধরে। দলটির পক্ষ থেকে জুলাই সনদ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। অন্য দলগুলোর বেশির ভাগ দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বলে, নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জানায় নির্বাচনের পরিবেশ নেই।
সংলাপে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশনের মেয়াদ ২০২৫ সালের আগস্টে শেষ হচ্ছে এবং এর আগেই জুলাই মাসে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে কমিশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের ওপর অর্পিত এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে অবশ্যই সফল হতে হবে।’
দলগুলো যা বলেছে : বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সব বিষয়ে যদি ঐকমত্য সৃষ্টি হয়, সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে, স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে, তাহলে সেটা হবে একটা অনন্য অপূর্ব বিষয়। তবে আমি এতটা বেশি আশা করতে পারব না।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা মনে করি, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান খুবই সম্ভব এবং এর আগেই জরুরি ভিত্তিতে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, বিশেষ করে নির্বাচনমুখী সংস্কারগুলোকে চিহ্নিত করে ঐকমত্যের মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন কোনো সংস্কার নেই যেগুলো এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। আমরা এরই মধ্যে রিপোর্ট পেয়েছি যে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অনেক অর্ডিন্যান্স এবং অনেক সংশোধনী এসেছে বিভিন্ন সেক্টরে, যেগুলো অলরেডি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরো অনেক বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আছে। সেগুলো অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে করা সম্ভব, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব, এমনকি কিছু কিছু সংস্কার অফিস আদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব। সংবিধান সংশোধনী ব্যতিরেকে একমত হওয়া অন্য সব সংশোধনী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে, অফিস আদেশের মাধ্যমে এক মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেটা আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে যাওয়ার মতো একটিও কারণ উল্লেখ করার মতো নেই, এই বিষয়টা আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এবং আমরা আবারও অ্যাপ্রোচ করেছি। আজকের বক্তব্যে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তাব আছে। এখন প্রধান উপদেষ্টা সেটি বিবেচনা করবেন, সেটা আমরা আশা করি এবং আমরা মনে করি, তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নিরপেক্ষভাবে সেই ভূমিকা পালন করবেন। কারো প্রতি রাগ, অনুরাগ, বিরাগ প্রদর্শন করবেন না।’
জুলাই সনদ সম্পর্কে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উনারা যেভাবে আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন, আগামী এক মাসের মধ্যে একটা সনদে আসা সম্ভব, ঐকমত্য আসা সম্ভব। কিছু কিছু বিষয়ে অবশ্যই দ্বিমত থাকবে, সব দল তো সব বিষয়ে একমত হবে, এমন আমরা আশাও করি না। তবে যেগুলো ঐকমত্যে আমরা আসতে পারব, সেই বিষয়গুলো অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে সংশোধন হবে। সেটা আমাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে আসবে এবং জাতির কাছে এটা একটা অঙ্গীকার হিসেবে থাকবে। তার আগে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদ স্বাক্ষরিত হলেই যথেষ্ট।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে এবং তাঁর নেতৃত্বেই আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন মত এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। তবে জামায়াতে ইসলামী মনে করে, জুন ও মে মাস আবহাওয়ার দিক থেকে নির্বাচনের জন্য অনুকূল নয়। তাই ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করা হয়েছে।’ এটি হলে জনমনে যে শঙ্কা রয়েছে, তা কেটে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসের মধ্যেই সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে হবে। অনেক বিষয়ে এরই মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খুব শিগগির সব দলকে একত্র করে একটি সমন্বয়সভা অনুষ্ঠিত হবে। যেসব বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। এরপর একটি জুলাই সনদ তৈরি হবে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তার একটি হলো সরকারের প্রতিশ্রুত সময় জুলাইয়ের মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা ছিল, আমরা তার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। দ্বিতীয়ত, আমরা বলেছি, জুলাই মাসে আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হবে। ৫ আগস্টের আগে জুলাই মাসের মধ্যেই যাতে সব দলের স্বাক্ষর নিয়ে জুলাই সনদটি কার্যকর করা হয়। বলেছি, জুলাই সনদ কার্যকর হওয়ার আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা ঠিক হবে না। জুলাই সনদ ঘোষণার আগে যদি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় তাহলে সংস্কারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। আমরা আরো দুই মাস অপেক্ষা করতে চাই এবং সরকারকে সময় দিতে চাই। জুলাই সনদ হওয়ার পরে আমরা জানাব যে কোন সময় আমরা নির্বাচন চাচ্ছি। এ ছাড়া আমরা বলেছি, আমাদের একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত যে আইন সে আইনগুলো সংস্কার করে এই কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এখন যে প্রক্রিয়ায় চলছে তাতে আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। এটি যেন সরকার বিবেচনায় নেয়।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার—এই তিনটি বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা প্রয়োজন। স্বাভাবিক কারণে অনেক রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বলেছে। যদি এর পরে নির্বাচন পেছাতে হয়, তবে তার একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বর্তমান সরকার কিছু সংস্কার করবে, বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার করবে। মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা বিরাজ করছে, তা দূর করতে হবে। আমরা শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বিষয়ে জানতে চেয়েছি। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা দূর করে আস্থা তৈরি করা জরুরি।’
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন কী করতে চায়, তার একটি রূপরেখা প্রয়োজন। গত ১০ মাসে এই সরকারের আমলনামার খতিয়ান এবং উপদেষ্টাদেরও আমলনামা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন নিয়ে সময়ের চেয়েও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা উচিত বলে তারা মনে করে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, বাইরের আগ্রাসী শক্তি বাংলাদেশকে গ্রাস করতে পারে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে, তা দূর করতে হবে। তিনি মনে করেন, দেশে বর্তমানে নির্বাচনের পরিবেশ নেই এবং তাঁরা কোনো প্রহসনের নির্বাচন চান না। তাঁর দাবি, আগে সংস্কার হোক, তারপর নির্বাচন। সংস্কারের আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে আরো অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তাই দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত। তিনি জুলাই মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে দেরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তবে তিনি নারী কমিশনের অনেক বিষয়কে ইসলামবিরোধী বলেও মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।