• শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ০৯:১৪ অপরাহ্ন

অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের ভাষা ও সাহিত্য সাধনা

নিজস্ব প্রতিবেদক / ৬৫ টাইম ভিউ
আপডেটঃ রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫

আমাদের দেশে অনেক লেখক-গবেষক আছেন, যারা বড় বেশি নিভৃতচারী। নীরবে কাজ করতেই ভালোবাসেন। নীরবে-নিভৃতে তারা আমাদের ভাষা, সমাজ নিয়ে নিরবধি গবেষণা করে চলেছেন। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে তারা উপহার দিয়ে চলেছেন তাদের নিবিড় গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও দিকনির্দেশনা। বয়স তাদের কাজের গতি থামাতে পারেনি। সে কারণেই তারা বরাবরই শ্রদ্ধেয় থেকে গেছেন। এমনই একজন লেখক, গবেষক এবং ভাষাবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান। অধ্যাপক আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী, আহমেদ শরীফ এবং আনিসুজ্জামানের স্নেহধন্য ড. মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। একসময় বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং কলা অনুষদের ডিন হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি অতুলনীয় ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। তবে ভাষাবিজ্ঞানী হিসাবে নিঃসন্দেহে তিনি অগ্রগণ্য। বরাবরই তিনি ‘বাংলাভাষা’র ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাধর্মী বই রচনা করে চলেছেন। যে বইগুলোতে তার নিরলস পরিশ্রমের ছাপ পাওয়া যায়। একইসঙ্গে উদারনৈতিক ভাবনা তার চিন্তাজগৎকে নিরন্তর আলোড়িত করে। এ গভীর সাধনাকে চিরন্তন করেই তিনি সৃষ্টিশীলতার মাঝে আকণ্ঠ ডুবে রয়েছেন।

তার লেখা সর্বশেষ গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ভাষা ও সাহিত্য সাধনা (সাহিত্য ও সংস্কৃতি খণ্ড)। নবরাগ প্রকাশনী থেকে এ বইটি প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের আগস্টে। বইটির মুখবন্ধে প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান বলেছেন, আসলে এ বইটি তার লেখা ‘ভাষা ও সাহিত্য সাধনার ২য় খণ্ড’। এর আগে বেরিয়েছে প্রথম খণ্ড। সূচিপত্রের বিন্যাস অনুযায়ী মোট ৭টি বিষয় নিয়ে বইটিতে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ভাষা’, ‘সাহিত্যচিন্তা’, ‘মহাফাল্গুন’, ‘রবীন্দ্র পাঠ’, ‘নজরুল’, ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ এবং পঞ্চভাষণ। বইটিতে বিষয়ভিত্তিক লেখাসহ বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দেওয়া লেখকের বক্তব্যও সংযোজন করা হয়েছে। ‘ভাষা’ পর্বে লেখক ভাষা, বাংলা ভাষা, উপভাষা, প্রনিতম্ব-এসবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, ভাষার ইতিবৃত্ত, বিবর্তন, ভাষার বৈচিত্র্য ও প্রসার, ভাষারূপ, আঞ্চলিক ভাষা, ভাষার উন্নয়ন, ভাষার রাজনীতি-ইত্যাদি বিষয়াবলি নিয়ে সূক্ষ্মতাসূক্ষ্মভাবে অনেক বিষয় উপস্থাপন ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। ভাষা নিয়ে যারা অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহলী তারা নিশ্চিত এগুলো পাঠ করলে অনেক নতুন বিষয় জানতে পারবেন। নতুন করে ভাববার অনুপ্রেরণা পাবেন। ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যম। তবে তাকে যত্ন ও চর্চা করা আবশ্যক।

নিঃসন্দেহে ভাষা বরাবরই একটি জটিল বিষয়। ভাষার উৎস খোঁজার দিন তাই এখনো শেষ হয়নি। যারা অনুসন্ধিৎসু তারা কাজ করছেন নিরন্তর। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামানও থেমে থাকেননি। বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তিনিও দেখার চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষারস্বরূপ, বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যময়তা, ভাষার কাঠামোর ভিন্নতা, পরিবর্তন ইত্যাদি। আসলে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার দীর্ঘ পথচলায় নানা ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাস ভালোভাবে জানতে চাইলে সন্দেহ নেই এ বইটি কিছুটা হলেও আমাদের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে। বইটির দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে ‘সাহিত্যচিন্তা’। এ পর্বের আলোচ্য বিষয় বাংলাদেশের সাহিত্যের সাহিত্যিক ধারা, আলাউদ্দিন আল আজাদের সনেট গুচ্ছ, বিংশ শতকের চিন্তাধারা ও মোতাহার হোসেন চৌধুরী এবং আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ (অতীত অন্বেষার ভাষার রূপ)। এ বইটিতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ‘ভাষার রাজনীতি ও রাজনীতির ভাষা, প্রসঙ্গ: ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আব্দুল হাই’। বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই-এর জন্মশতবার্ষিকী স্মারক বক্তৃতা এটি। এখানেও আছে অগ্রবর্তী মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর ভাষাবিষয়ক চিন্তা ও নিরীক্ষার প্রতিফলন।

একথা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান সাগর সেঁচে বরাবরই তিনি মুক্ত খোঁজ করতে চেয়েছেন। আর তাই ভাষার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ যেন তিনি ব্রত হিসাবেই নিয়েছেন। এ কারণেই বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের সৃষ্টিশীল সাধনায় তিনি এখনো মত্ত। ভাষাকে তিনি প্রাণের চেয়েও প্রিয় বলে জ্ঞান করেন। এ কারণেই তার আত্মনিবেদন অহংকার করার মতো।

এ বই এর একটি পর্ব মহাফাল্গুন। এ পর্বে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা সন্নিবেশিত করেছেন। এসব লেখায় ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, বাংলা ভাষার বিশেষত্ব, ভাষার সামাজিক শক্তি, ভাষানীতি, ভাষার প্রেক্ষাপটে আগামীর প্রত্যাশা-ইত্যাদি বিষয়গুলো নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি ঘটনায় বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে তিনি নিজস্ব মতামত দিয়ে আগামী দিনের স্বপ্নের কথাও বলেছেন। সন্দেহ নেই বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। তবে এ বইটিতে লেখক যতটুকু আলোকপাত করেছেন তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ‘বিস্ফোরণের দ্বারপ্রান্তে-মহান একুশ’ শিরোনামের লেখায় তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘একুশ-এর একটা দিক তার ঐতিহাসিকতার দিক। বায়ান্নোর ইতিহাস। এবং পরপর যে জাতীয় চেতনা স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তার কালগত ধারাপঞ্জি হলো একটা দিক। আর একটা দিক হচ্ছে, অজস অজস যে রক্তের ধারা বন্যার মতো প্রবাহ-প্লাবন নিয়ে বয়ে গেছে, তার শোক, তার প্রতিবাদ এবং তার দ্রোহ উচ্চারণের মধ্যে জাতির ভাষাবোধকে তীব্রতরো করা।’ (পৃষ্ঠা-১৪৯)। বাংলা ভাষার অপব্যবহার ও বিকৃতি নিয়ে লেখকের দুঃখবোধের কমতি নেই। বলেছেন এত রক্ত দিয়ে যে ভাষা কেনা সেই ভাষার বিকৃতি, অপমান দুঃখজনক। আর তাই এফএম রেডিওসহ যেখানে ভাষার বিকৃতি নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের মাহাত্ম্য এ প্রজন্মকে উদ্বেল করে না, ভাষাক্রম ধরে রাখারও কোনো দায় নেই তাদের।

এ বইয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ‘রবীন্দ্র পাঠ’। এ অধ্যায়টি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই বিস্তৃত। এ অধ্যায়ে ‘মহামানবের সাগর তীরে’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গীতবিতানের কথা’, রবীন্দ্রকাব্যর ‘নির্বাচন ও সংকলন প্রমাদ্দ’,-এরকম পাঁচটি বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রাথকে নিয়ে নানা পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে বিস্তর গবেষণা ও লেখালেখি চলমান। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান তার অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার ভাবনার জগৎ বিস্তৃত করেছেন। ‘মহামানবের সাগর তীরে’ লেখাটি তিনি ২০১৪ সালের ৯ মে লিখেছিলেন দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায়। ছোট একটা লেখা। কিন্তু এ লেখার রেশ বেশ দীর্ঘ। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র ভাবনাকে তিনি বলেছেন এ এক বিরাট সাধনা। রবীন্দ্রনাথের লেখালেখির বড় অংশ হলো-তার অমর সৃষ্টি গান। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অনেক কথাই তুলে ধরেছেন। তিনি এক পর্যায়ে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কাব্য দর্শনটি ছিল সীমার মাঝে অসীমের অনুভূতি কাতর। তার সঙ্গীতের দর্শনও অনুরূপ-বৃত্তের মাঝে অনাবৃত্ত তরঙ্গায়ন।’ লেখক নিজেই বলেছেন, অপরিমেয় প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রায় সব শাখায় যেমন অপ্রতিহত বিচরণ করেছেন, তেমনি শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও অবদান রেখেছেন বিস্ময়কর রূপে। আসলেই তাই রবীন্দ্রনাথ পাঠ না করলেই জীবনের অনেক কিছুই অসমাপ্ত থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, গান, কবিতা এবং শিক্ষাদর্শনবিষয়ক লেখা-আমাদের সবার জন্য পাঠ জরুরি। কত কথা তিনি লিখে গেছেন। তার শিক্ষাচিন্তাগুলোর মধ্যে অনেক কিছু রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এক ধরনের লেখার দিকে ঝুঁকে থাকেননি। সব বয়সিদের জন্য লিখেছেন। পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে লিখেছেন। বিজ্ঞানের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। এমন বহুমুখী প্রতিভা আর দ্বিতীয়টি জন্মায়নি বাংলায়। চারপাশে চোখ রেখে লিখেছেন। তার লেখা এখনো সমান গুরুত্ব বহন করে। নতুন ধারণার আলোকপাতের সূত্রপাত তৈরি করে। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামানও অকপটে বলেছেন রবীন্দ্রপাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।

রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি কবি নজরুল ইসলামকে নিয়েও প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান নিজের বিশদ ভাবনার সম্মিলন করেছেন তার নানা লেখায়। এ বইতে তিনি নজরুলকে নিয়ে চারটি লেখা সংযুক্ত করেছেন। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসাবে স্বীকৃত। তিনি সেই পটভূমির উৎস ও ঠিকানা খুঁজেছেন। নজরুলকে নিয়ে লেখায় তিনি বিভিন্ন আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। বলেছেন, নজরুল তার সৃষ্টিতে কখনো হেসেছেন, কখনো তিনি কেঁদেছেন সত্য, কিন্তু তার চেয়ে সত্য তিনি জীবনকে উজাড় করে দিয়েছেন সাহিত্যে-সর্বরসে এবং সর্বচিন্তা ও আবেগ মূর্ছনায়। এর কারণ তিনি জীবনকেই ঢেলেছেন তার সাহিত্য, দ্রোহে ও একান্ত অনুরাগে।

প্রফেসর ড. মুনিরুজ্জামানের পৈতৃক গ্রাম নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার আদিয়াবাদ। এ আদিয়াবাদ ঘিরে তার আবেগ অন্তহীন। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুর সঙ্গে মিশিয়ে রেখেছেন আদিয়াবাদকে। কিছুদিন আগে তার আমন্ত্রণে তার নামে হওয়া ‘মনিমেলায়’ গিয়েছিলাম। দেখে এলাম সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য প্রসারে তার বহুমাত্রিক কাজের নমুনাসহ। আর দেখলাম তার প্রতি ওই অঞ্চলের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। শ্রদ্ধা। বইটির সবশেষে যুক্ত হয়েছে সরকারি আদিয়াবাদ স্কুল ও কলেজে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনের মুখ্য অভিভাষণ : মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা শীর্ষক একটি লেখা। এ লেখাটিতে তিনি নিজের বাল্যকাল থেকে শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে তুলে ধরেছেন। যারা উৎসাহী, অনুসন্ধানী তারা এ লেখা থেকে অনেক কিছুই জানতে পারবেন। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের সমসাময়িক সময়ের বেশকিছু পরিবর্তন নিয়েও তিনি মতামত দিয়েছেন। বলেছেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সমমানের করতে হবে। সেটা করা না গেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে ভেদ ও বৈষম্য থাকবেই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বড় ধরনের গুণগত বৈষম্য ও অসংগতি রয়ে গেছে। এসব দূর করতেই উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের এ লেখা সেই পরিবর্তনের তাগিদেরই একটি অংশ।

Advertisement


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এই বিভাগের আরো খবর