জীবদ্দশাতেই কবি নজরুল নিজেকে দেখে গেছেন ডাকটিকিটে। এমন রাজকীয় সমাদর জগতের কম মনীষীরই জুটেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী এই কবি কত না চিঠি পাঠিয়েছেন খামের ওপর রাজা পঞ্চম জর্জ আর ষষ্ঠ জর্জের প্রতিকৃতি-সংবলিত ডাকটিকিট এঁটে! কিন্তু নিজের প্রতিকৃতি-সংবলিত ডাকটিকিটকে নজরুল তাঁর কোনো চিঠিতে সেঁটেছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, কারণ তখন কবি ছিলেন বাকরুদ্ধ। আজ কবির ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পড়ুন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ডাকটিকিট নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন।
১৯৬৮ সালে তত্কালীন পাকিস্তান ডাক বিভাগ বাংলা ভাষার কবি নজরুলকে নিয়ে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে। নজরুলের প্রথম ডাকটিকিট অবমুক্ত করার এক সপ্তাহ আগেই তখনকার ডাক বিভাগ টিকিটের ছবিসহ সমস্ত প্রচার মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু ডাকটিকিটে ধরা পড়ল মস্ত বড় ভুল। কবির জন্মবর্ষ ১০ বছর পিছিয়ে লেখা হয়েছে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ। এ নিয়ে দু-তিন দিন ধরে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় তখন প্রচুর লেখালেখি হয়েছিল। অবশেষে ডাকটিকিট প্রকাশের তারিখ গেল পিছিয়ে, ভুল সংশোধন করে মাস খানেক পর অবমুক্ত করা নজরুলের ডাকটিকিট। ভুল তবু রয়েই গেল, এবার কবিতায়। ডাকটিকিটে ছাপা হলো—‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে নাহি কিছু বড়/নাহি কিছু মহীয়ান।’
কিন্তু গণমানুষের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার এই অংশে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন নকশাকার। কবিতায় আছে—‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই/নহে কিছু মহীয়ান।’ দ্বিতীয় দফায় আর সংশোধনে না গিয়ে ডাক বিভাগ কবিতায় ওই ভুলসমেতই ডাকটিকিট প্রকাশ করল ১৯৬৮ সালের ২৫ জুন। যদিও তা প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল কবির জন্মদিন ২৫ মে তারিখে। ১৫ ও ৫০ পয়সা সমমূল্যের টিকিট দুটো একই নকশায় হলেও ছিল ভিন্ন ভিন্ন রঙের। হালকা হলুদ ও বাদামি এবং লাল ও বাদামি রঙের ডাকটিকিটগুলোর পাশাপাশি নিয়মমাফিক উদ্বোধনী খাম আর বিশেষ সিলমোহরও প্রকাশ করেছিল তত্কালীন ডাক বিভাগ।
১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হল। ১৯৭৬ সালে কবি জগত্সংসারের মায়া ত্যাগ করলেন। বাংলাদেশের ডাক বিভাগ এই মহান কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণ করেছিল দুটো ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকিটে প্রথমবারের মতো উঠে এলেন কোনো কবিব্যক্তিত্ব।
১৯৭৭ সালের ২৯ আগস্ট কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত ৪০ পয়সা ও দুই টাকা ২৫ পয়সা মূল্যমানের সেই ডাকটিকিটে দেখা যায় কবির প্রতিকৃতিসহ তাঁর রচিত বাংলাদেশের রণসংগীতের চারটি চরণ—
‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল’
এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দুটি চরণ—
‘বল বীর—
চির উন্নত মম শির!’
পরবর্তীকালে ১৯৯৯ সালে কবির শততম জন্মদিনকে ঘিরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ আরও একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ছয় টাকা মূল্যমানের বর্ণিল এ ডাকটিকিটে পুনরাবৃত্তি হয়েছে ‘মানুষ’ কবিতার অংশবিশেষ। ভারতের ডাক বিভাগও কাজী নজরুল ইসলামের শততম জন্মবর্ষ স্মরণীয় করে রেখেছে তিন রুপি মূল্যমানের একটি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশিত ডাকটিকিটে কবির যে প্রতিকৃতি ব্যবহূত হয়েছিল, ভারতীয় ডাক বিভাগও একই প্রতিকৃতি গ্রহণ করে; তবে এবার কবিকে দেখা যায় হাস্যোজ্জ্বল।
কাজী নজরুল ইসলাম স্কুলজীবন শেষ না করেই সৈনিক জীবন বেছে নিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে প্রায় ৩০ মাস তিনি বাঙালি পল্টনের সঙ্গে করাচিতে অবস্থান করেছেন। তখন তিনি ফারসি ভাষা সাহিত্যে জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীকালে ফারসি কবিতার প্রতি কবির অনুরাগের বহু নমুনা আমরা খুঁজে পাই তাঁর অনেক কবিতা ও সংগীতে। ফারসি ভাষা-সাহিত্যের লীলাভূমি সাবেক পারস্য যা বর্তমানে ইরান নামে পরিচিত। ২০০৪ সালের ৩ জুন ইরান-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব উপলক্ষে প্রকাশিত ১০ টাকা মূল্যের দুটি আলাদা ডাকটিকিটে তাই প্রাসঙ্গিকভাবেই স্থান পেয়েছেন পারস্যের কবি হাফিজ সিরাজী ও বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম।
কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবি’ তকমা জুটেছিল তাঁর তুমুল আলোচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ১৯২১ সালের শেষ দিকে। বিদ্রোহী কবিতা রচনার ৯০ বছর পূর্তিকে ঘিরে ‘আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলন-২০১১’ উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০১১ সালে নজরুলের চারটি ডাকটিকিটসহ একটি ‘স্মারক পাতা’ প্রকাশ করে। স্মারক পাতায় কবিতার ব্যবহার এ দেশের ডাক প্রকাশনাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। স্মারক
পাতাটিতে বিদ্রোহী কবিতার নিম্নোক্ত অংশটি ছাপা হয়—
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
সৈনিক বেশে নজরুলের আলোকচিত্র ঘিরে রেখেছে চারটি বর্ণিল ডাকটিকিট, প্রতিটি টিকিটের বুকে রয়েছে কবির নানা বয়সের প্রতিকৃতি আর তার পাশে বিদ্রোহী কবিতার ১২টি চরণ। কবির চৌধুরীর অনুবাদে ওই কবিতাটির নির্দিষ্ট অংশের ইংরেজি, এই হল ‘স্মারক পাতা’র সারসংক্ষেপ। ১০০ টাকা মূল্যমানের এই স্মারক পাতা পারফোরেশনসহ এবং পারফোরেশনবিহীন দুভাবেই ছাপা হয়। প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে কবির প্রতিকৃতি ছাড়াও বাংলাদেশে তার স্মৃতিবিজড়িত স্থাপত্যও উঠে এসেছে। ডাকটিকিট ও স্মারক পাতার পাশাপাশি উদ্বোধনী খাম ও বিশেষ সিলমোহরও অবমুক্ত করেছে ডাক বিভাগ।
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে যথাক্রমে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। একই ব্যক্তিকে উপমহাদেশের তিনটি দেশ তাদের ডাক প্রকাশনার মাধ্যমে স্মরণ করেছে এমন ঘটনাও বিরল। কবি নজরুলকে পাঠের এই ভিন্ন মাধ্যমটি হয়তো ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে, হয়তো নজরুলকে নিয়ে প্রকাশ করা হবে এমন আরও বহু-বর্ণিল ডাকটিকিট।
তথ্যসূত্র:
১. মজার শখ ডাকটিকিট সংগ্রহ, ড. কাজী শরীফুল ইসলাম
২. Scott Stamp Catalogue, 2007
৩. Postage Stamps of Bangladesh, Bangladesh Post Office
৪. সৈনিক নজরুল, মুহাম্মদ লুত্ফুল হক, প্রথমা প্রকাশন