• শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ০৮:১৯ অপরাহ্ন

পাট-কচুরিপানার পণ্য যাচ্ছে ইউরোপে

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১০ টাইম ভিউ
আপডেটঃ রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫

স্বর্ণালংকার বিক্রি করে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা হাতে নিয়েছিলেন সাবেকুন্নাহার মিতু। উদ্দেশ্য ছিল স্বাবলম্বী হওয়া। আজ সেই টাকা থেকেই গড়ে উঠেছে ‘লাম ক্রিয়েশন’। একটি হস্তশিল্প কারখানা—যার তৈরি পাট, হোগলাপাতা, কচুরিপানা ও ছনের পণ্য যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

 

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ব্যাসদি গ্রামের মিতুর এই কারখানা এখন শুধুই একটি উদ্যোগ নয়, বরং একটি বদলে যাওয়ার গল্প। নিজের স্বামী মো. রেজাউল করিমের সহায়তায় ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময়কার কঠিন সময়ে শুরু করেন এই উদ্যোগ। শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কামালদিয়া ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে পড়াশোনা শেষে যখন চাকরি নেই, দিশাহীন সময়—তখন নিজের জমানো অর্থ আর গয়না বিক্রি করে শুরু করেন ছোট কারখানা।

শুরুতে ১৫ জন নারী শ্রমিক, ১২টি মেশিন নিয়ে চলত কাজ।

এখন দুটি কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ২০০ নারী শ্রমিক। শুধু তাই নয়, চুক্তিভিত্তিক আরো ৩০০ নারী কাজ করছেন আশপাশের গ্রামে। রাজবাড়ীর কোলারহাটেও আছে ‘লাম ক্রিয়েশন’-এর আরেকটি কারখানা। 

পাট-কচুরিপানার পণ্য যাচ্ছে ইউরোপে

সাবেকুন্নাহার মিতু

নারী ক্ষমতায়নের এই সাহসী পথচলার স্বীকৃতি হিসেবে সাবেকুন্নাহার মিতু পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তা সম্মাননা, যা দেওয়া হয়েছে দেশের মাত্র ছয়জন উদ্যোক্তাকে।

 

স্বপ্নটা শুরু হয়েছিল নিজের জন্য, কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে উঠেছে শত শত নারীর জীবনের দিশারি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এক দিন পর পর এক ট্রাক পণ্য দেশ-বিদেশে রপ্তানি হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এসব পণ্য বায়ারদের মাধ্যমে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। প্রতি মাসে ‘লাম ক্রিয়েশন’ কারখানা থেকে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব পড়ছে এসব শিল্প গড়ে ওঠায়।

 

সরেজমিনে কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পাট, হোগলাপাতা, কচুরিপানা ও ছন দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ, ম্যাট, পাপস, পেট হাউস, ফাইল বক্স, বাস্কেট, ফুলের টব, বাটি, ঝুড়ি, টিফিন বক্স, টিস্যু বক্সসহ প্রায় অর্ধশতাধিক বাহারি পণ্য। এসব পণ্য তৈরিতে নারীদের সঙ্গে পুরুষ শ্রমিকরাও কাজ করছেন। কেউ পণ্য তৈরি করছেন, কেউ ফিনিশিং, চেকিং ও সুতা ববিনে ভরছেন। আবার কেউ তৈরি পণ্য সাজিয়ে রাখছেন। পরে এগুলো রপ্তানির জন্য যাচাই-বাছাই করছেন অনেকে। এসব পণ্যের কাঁচামাল হোগলাপাতা নোয়াখালী ও ভোলা থেকে সংগ্রহ করা হয়। আর ঢাকার সদরঘাট থেকে সুতা আনা হয়। এই কারখানায় ৫০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা হয়।

কারখানার শাওন মোল্যা নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘দারিদ্র্যের কারণে বাবার বাড়ি কুষ্টিয়া থেকে নানাবাড়ি মধুখালীতে থাকি। অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করতে পারিনি। লাম ক্রিয়েশন কারখানাটি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমার মতো বেকাররা এখানে কাজ করতে পারছি। এখান থেকে যে বেতন পাই তা দিয়ে মা-বাবার সংসারে সহযোগিতা করতে পারি। বাড়িতে থেকেই মাসে ভালো টাকা আয় করতে পারছি আমি।’

লাম ক্রিয়েশন হস্তশিল্প কারখানার স্বত্বাধিকারী সাবেকুন্নাহার মিতু বলেন, ‘পড়ালেখা শেষ করে করোনা মহামারির মধ্যে যখন হতাশায় ছিলাম, তখন নিজের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে এবং কিছু জমানো টাকা দিয়ে লাম ক্রিয়েশনের যাত্রা শুরু করি। পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ১২টি মেশিন ও ১৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দিই। এখন আমার কারখানায় ২০০ শ্রমিক এবং গ্রামে চুক্তিভিত্তিক আরো ৩০০ শ্রমিক কাজ করছেন। এখানে পাট, হোগলাপাতা, সুইং সুতা ও কচুরিপানা দিয়ে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারোপযোগী বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কারখানা থেকে প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার পণ্য দেশ-বিদেশে বায়ারের মাধ্যমে রপ্তানি করছি। তাতে প্রতি মাসে আমার সব খরচ বাদে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। কারখানাটি করে আমিও স্বাবলম্বী হয়েছি এবং এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি।’ স্বল্প সুদে সরকারি সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে লাম ক্রিয়েশনে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে বলে তিনি আশাবাদী।

ফরিদপুর বিসিকের প্রমোশন কর্মকর্তা মো. মাইনুল হাসান বলেন, ‘জেলার মধ্যে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প পলো, হাতপাখা তৈরি হচ্ছে—বিষয়টি আমাদের নলেজে আছে। তবে পাট, হোগলাপাতা, কচুরিপানা দিয়ে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে, বিষয়টি সবেমাত্র জানলাম। এই কারখানার বিষয়ে কেউ কখনো আসেনি। কারখানাটি আমাদের অফিসে কোনো সহযোগিতা চাইলে ট্রেনিংসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।’

 

 


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এই বিভাগের আরো খবর