মেঘমেদুর দিনের শেষে গান, নাচ, সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদানের জমকালো আয়োজনে সম্পন্ন হলো মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠান। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে দেশের বিনোদনজগতের তারকাদের দ্যুতিময় সমাবেশে পুরস্কৃত করা হলো কৃতিত্ব অর্জনকারীদের।

এটি ছিল মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কারের ২৬তম আসর। বরাবরের মতো এবারও একটি আজীবন সম্মাননা এবং বিভিন্ন বিভাগে মোট ২০টি পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় দেশের চলচ্চিত্রের সুপারস্টার শাকিব খানকে। পুরস্কার বিতরণের ফাঁকে ফাঁকে ছিল আকর্ষণীয় নাচ–গানের মনমাতানো পরিবেশনা।

হল অব ফেমের লবিতে বিছানো লালগালিচা দিয়ে বিনোদনজগতের তারকাদের মিলনায়তনে প্রবেশের পর্ব শুরু হয় বিকেল পাঁচটা থেকে। তাঁদের অভিমত ও কাজের পরিচিতি তুলে ধরে তা মিলনায়তনের ভেতরের বড় পর্দায় দেখানো হয়। মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল সন্ধ্যা ছয়টায়। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাশিল্পী আনিসুল হক অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, এ অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান দর্শক, শিল্পী, অনুষ্ঠানের সহযোগী স্কয়ার গ্রুপসহ সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। তবে তিনি এখন দেশে নেই। সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের ‘ইনমা গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’-এ প্রথম আলো পেয়েছে ‘দক্ষিণ এশিয়ার সেরা’র পুরস্কার। এই পুরস্কার গ্রহণের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনার সংবাদ প্রচার এবং পরে এ নিয়ে প্রদর্শনী, বিশেষ সংখ্যা, বই প্রকাশসহ বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য প্রথম আলো পুরস্কৃত হয়েছে। পর্দায় সম্পাদক মতিউর রহমানের পুরস্কার গ্রহণের দৃশ্যটি দেখানো হলে দর্শকেরা করতালিতে অভিনন্দন জানান।

স্কয়ার টয়লেট্রিজের পক্ষে বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মালিক মোহাম্মদ সাঈদ। তিনি বলেন, স্কয়ার দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে যুক্ত রয়েছে। দেশের বিনোদনজগতের সৃজনশীল কাজ ও গুণী শিল্পীদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কৃত করার এ আয়োজন আনন্দ ও গৌরবের।

এরপর মঞ্চে আসেন বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা আফজাল হোসেন। মেরিল–প্রথম আলোর যাত্রার ইতিহাস দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে শুরু হয়েছিল এ আয়োজন। তিনি ও জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফা সঞ্চালনা করেছিলেন সেই অনুষ্ঠান। কথায়–কথায় জানালেন, এবার তিনি মঞ্চে এসেছেন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পর্বের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে। এবারের আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত বহুগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্ব আবুল হায়াতের নাম ঘোষণা করেন তিনি। মঞ্চের নেপথ্যের বিশালাকার ডিজিটাল পর্দায় দেখানো হলো অভিনেতা, নাট্যকার, নির্মাতা, মডেল ও কলামিস্ট আবুল হায়াতের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের দৃশ্য।

আবুল হায়াতকে মঞ্চে নিয়ে আসেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। তিনি আবুল হায়াতকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। তাঁর হাতে পুরস্কারের ক্রেস্ট তুলে দেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান। দর্শকেরা করতালিতে তাঁদের অভিনন্দিত করেন।

এরপর সমবেত নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে পুরস্কার বিতরণী পর্বের শুরু। যন্ত্রবাদনের সঙ্গে ধ্রুপদি নৃত্য পরিবেশন করেন তমা মির্জা, মন্দিরা চক্রবর্তী ও হৃদি শেখ এবং সোহাগ ড্যান্স ট্রুপের শিল্পীরা।

নাচ শেষ হলে বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী প্রয়াত হুমায়ুন ফরীদির সংলাপের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতিকৃতি নিয়ে মঞ্চে আসেন অভিনেতা আফরান নিশো। এরপর আসেন অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ। পুরস্কার ও মনোনয়ন নিয়ে মজার মজার কথামালায় অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নেন দুজন মিলে। শুরু হয় পুরস্কার বিতরণ পর্ব। প্রথমে ওয়েব সিরিজের সমালোচক পুরস্কার—সেরা নির্মাতা, অভিনেত্রী, অভিনেতা পুরস্কার। বিচারকমণ্ডলীর পরিচিতি ও প্রতিটি বিভাগেই মনোনীতদের নাম ঘোষণার পর পর্দায় সংক্ষিপ্ত দৃশ্য ফুটে ওঠে। তারকারা বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অভিনেত্রী আফসানা মিমি ও নির্মাতা আশফাক নিপুন। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন তাঁরা।

ওয়েব সিরিজের বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার বিতরণের পর গান নিয়ে বেশ খানিকটা কথোপকথন চলতে থাকে সঞ্চালক আফরান নিশো ও তাসনিয়া ফারিণের মধ্যে। এর মধ্যে ‘দুষ্টু কোকিল’ গানের সঙ্গে সহশিল্পীদের নিয়ে মঞ্চে আসেন বিদ্যা সিনহা মিম। নৃত্যের মাঝখানে এসে অংশ নেন রেহান ও কনা।

এরপর ছিল সীমিত দৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের পুরস্কারের পালা। সেরা চিত্রনাট্যকার, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেত্রী ও সেরা অভিনেতা বিভাগে কারা কারা মনোনয়ন পেলেন, তা দেখানো হলো পর্দায়। তারপর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে পুরস্কার তুলে দেন অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ ও অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা।

পুরস্কার বিতরণ পর্বের পর দুই সঞ্চালক হলুদ সাংবাদিকতা ও তার নমুনা হিসেবে কিছু আজগুবি সংবাদের শিরোনাম রচনা করলেন। পর্দায় দেখানো হলো কিছু সরস ভিডিও। এ পর্যায়ে শুরু হয় টিকটকের ট্রেন্ডে থাকা বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ পরিবেশনা। এতে অংশ নেন মুমতাহিনা টয়া, তৌসিফ মাহবুব, ইরফান সাজ্জাদ, প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, টুইং কেরল ও দোলা রহমান।

পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র বিভাগের পুরস্কার প্রদান পর্ব ছিল এরপর। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অভিনয়শিল্পী শহীদুজ্জামান সেলিম ও আজমেরী হক বাঁধন।

এরপর ছিল চলচ্চিত্রজগতের মেগাস্টার শাকিব খানকে নিয়ে বিশেষ চমক। ২৫ বছর ধরে তিনি চলচ্চিত্রশিল্পে অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর কাজের বিশেষ দৃশ্যগুলো তুলে ধরা হলো পর্দায়। পূজা চেরী, নিরব, ইমন ও রোশানের অংশগ্রহণে ‘প্রিয়তমা’, ‘রাজকুমার’, ‘দিল দিল দিল’, ‘আসছে তুফান’সহ বিভিন্ন গানের সঙ্গে ছিল বিশেষ নৃত্য পরিবেশনা।

স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী ও নির্মাতা মতিন রহমান দর্শকদের বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে শাকিব খানকে মঞ্চে নিয়ে আসেন এবং বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের রজতজয়ন্তীর বিশেষ সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে শাকিব খান তাঁর ভক্ত ও সম্মাননা জানানোর জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, দেখতে দেখতে অনেক বছর হয়ে গেল। বিগত দিনে অনেক আনন্দ–বেদনা, উত্থান-পতনের স্মৃতি রয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও চলচ্চিত্রের এই অগ্রযাত্রায় তিনি ভূমিকা পালন করে যেতে চান।

এরপর ছিল তারকা জরিপ পুরস্কার। শুরুতেই নবীন অভিনয়শিল্পী ও সেরা গায়ক-গায়িকা বিভাগে পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য মঞ্চে আহ্বান জানানো হলো জনপ্রিয় শিল্পী কনকচাঁপা ও বাপ্পা মজুমদারকে। বিজয়ীদের হাতে তাঁরা তুলে দেন পুরস্কার। পুরস্কার বিতরণের পর আফরান নিশোর অনুরোধে ‘উরাধুরা’ গানটি ভাওয়াইয়া, রবীন্দ্রসংগীত ও ব্যান্ডের সুরের নমুনা হিসেবে খানিকটা করে গেয়ে শোনান ফারিণ।

গানের পর আবারও তারকা জরিপ পুরস্কারের পর্ব। এবার টিভি নাটক, ডিজিটাল মাধ্যমে সীমিত দৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, টিভি সিরিজ এবং ওয়েব সিরিজের যথানিয়মে মনোনয়ন ও পরিচিতি তুলে ধরার পর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু ও অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু।

শেষে ছিল তারকা জরিপে সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা ও অভিনেত্রীর পুরস্কার পর্ব। বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে পুরস্কার তুলে দেন নন্দিত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ ও অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন। সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন শাকিব খান। পুরস্কার গ্রহণের পর তাঁকে নিয়ে তাসনিয়া ফারিণ ও আফরান নিশোর মধ্যে শুরু হয় সরস সংলাপ। এমন সময় ‘লাগে উরাধুরা’ গান গেয়ে ঈগল ড্যান্স গ্রুপের নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে মঞ্চে আসেন প্রীতম হাসান। তারপর সবাই মিলে গানের সঙ্গে জমজমাট নৃত্য পরিবেশনা।

অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা, পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ছিলেন প্রথম আলোর হেড অব কালচারাল প্রোগ্রাম গীতিকবি কবির বকুল। সবাই মিলে একসঙ্গে গ্রুপ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় পুরস্কার বিতরণের জমকালো আয়োজন।