ঠুমরি মূলত ভাবপ্রধান সংগীতের একটি ধারা। অনেকে মনে করেন, নৃত্যের ‘ঠমক’ শব্দ থেকে ‘ঠুমরি’ শব্দটি জাত।
ঠুমরি মূলত ভাবপ্রধান সংগীতের একটি ধারা। অনেকে মনে করেন, নৃত্যের ‘ঠমক’ শব্দ থেকে ‘ঠুমরি’ শব্দটি জাত।
উচ্চাঙ্গসংগীতের যেকোনো গীত পরিবেশনের জন্য তার গায়ন পদ্ধতির ওপর শিল্পীর গায়কি নির্ভর করে। তেমনি ঠুমরিশৈলী পরিবেশনের ক্ষেত্রে ঠুমরিগান পদ্ধতির সঙ্গে এর গায়কি নির্ভর করে।
ঠুমরির যে কারুকাজে সুরের মাধুর্য বৃদ্ধি পায়, বাংলা গানে অতুল প্রসাদ সেন কেবল সেটুকুই গ্রহণ করেছেন। ঠুমরিতে যে সুর-বিস্তার, তা তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন। এই সুর-বিস্তার বাংলা গানকে অহেতুক দীর্ঘ ও ভারাক্রান্ত করবে এমন একটা আশঙ্কার কথা হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল। আমরা জানি নজরুলের সংগীতসম্ভার সুর-মাধুর্যে ভরপুর। নজরুলসংগীতে সুরের মর্যাদা বেশি। সুর-মাধুর্য তাঁর বাণীবৈশিষ্ট্যকে ছাড়িয়ে গেছে। নজরুলসংগীত যেন সুরসুধায় সিক্ত। অতুল প্রসাদ সেনের সঙ্গে নজরুলের সহধর্মিতা বিশেষ ঔত্সুক্যের সৃষ্টি করে। আগেই আলোচিত হয়েছে, বাংলা গানে ঠুমরি চলনে সংগীত সৃষ্টিতে অতুল প্রসাদ সেন প্রবর্তক হিসেবে কাজ করেছেন। সুর রচনার ক্ষেত্রে অতুল প্রসাদের সঙ্গে কাজী নজরুলের এক বিশেষ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ দুই সংগীত স্রষ্টাই নতুনের জয়গান গাইতে পছন্দ করতেন।
বাংলা গানে অতুল প্রসাদ সেন ঠুমরির যে ব্যাপক প্রচলন করেন, এ বিষয়টি নতুন সংযোজন হিসেবে বিবেচিত। ঠুমরির আমেজে তাঁর বেশির ভাগ গানই সুরেলা, চিত্তহারী। নজরুলের গানেও এই আমেজটি লক্ষ করা যায়। নজরুল সৃষ্ট সংগীতভাণ্ডারে ঠুমরি ঘরানার গানগুলো বাংলা সংগীতসম্ভারকে আরো বেশি গৌরবান্বিত করেছে। যেকোনো কারণবশতই হোক, বাংলা গানে নজরুলের আগে ঠুমরির ব্যবহার কখনোই ব্যাপকভাবে হয়নি। ঠুমরির আঙ্গিকে রচিত গানে অর্থাৎ বাণী ও সুরভঙ্গির পারস্পরিক সমন্বয় রেখে গান রচনায় কাজী নজরুল অসাধারণ। ঠুমরি রাগসংগীতের সর্বশেষ ধারা হিসেবে আমাদের বাংলা সংগীতে মিশে গানের গায়নশৈলী ও কাব্যিক ধারাকে অনেক বেশি ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে বহুলাংশে এবং নজরুলসংগীতের একটি অংশ জুড়ে আছে ঠুমরির আঙ্গিকে রচিত গানগুলো। ঠুমরি প্রকৃতির বাংলা রাগপ্রধান সংগীতধারায় নজরুলের সৃষ্ট এই চলনের গানগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
বাণী, সুর, তাল, লয় ও গায়নরীতি—এই সবকিছুর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে নজরুলসংগীত সম্ভারে বাংলায় রচিত ঠুমরি চালের গান বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে আছে। ঠুমরিগানের বিষয়বস্তুতে দেখতে পাওয়া যায় নারীর পক্ষ থেকে স্ত্রী-পুরুষের প্রেমবিষয়ক উক্তি। পক্ষান্তরে পুরুষের পক্ষ থেকে প্রেমবিষয়ক কোনো কথা বা বাক্য বড় একটা থাকে না। এককথায় বলতে গেলে, ঠুমরির কাব্যভাব একতরফা বিষয়।
এমনকি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও নারীর ওই রকম প্রেমকথা আপন আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে ভক্তিরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে নারীকে শ্রীরাধারূপে এবং তার প্রিয়তমকে শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ পরিগণিত বা মানা হয়ে থাকে। নজরুলের ঠুমরিগানের সুর সৌকুমার্য পরম্পরায় উপরোক্ত বিষয়বস্তুর আলোকে তার কাব্যিক মূল্যও মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এতে গানগুলো যে ঠুমরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তার প্রকৃত মাপকাঠি নির্ণয় করা সহজ হয়। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের উপমহাদেশীয় রাগসংগীত অন্তর্গত ঠুমরির এবং বাংলা রাগসংগীত অন্তর্গত ঠুমরির মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তদুপরি কাজী নজরুল ইসলাম ঠুমরির মূলধারা মাথায় রেখে নিজের নিজস্বতা, বৈচিত্র্যময়তা সমুন্নত রেখে নিজের সৃষ্ট বাংলায় রচিত ঠুমরি সংগীতধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় উপস্থাপন করেছেন। সে ক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে, বাংলা রাগসংগীত বা রাগপ্রধান গানে ঠুমরির সংযোজন নজরুলের এক অমর কীর্তি। এবার তাঁর ঠুমরি অঙ্গের গানগুলোর প্রতি লক্ষ করা যাক। বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়, নজরুলসংগীতের ঠুমরির গানগুলো রাগপ্রধান, কাব্যগীতি, ভক্তিগীতি প্রভৃতি শ্রেণির গানগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা আছে।
নজরুলের ঠুমরি শ্রেণিভুক্ত গানগুলো রাগপ্রধান গানের স্বতন্ত্র অঙ্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নজরুল রচিত ঠুমরিশৈলীতেও প্রকৃত ঠুমরির বৈশিষ্ট্যসমূহ খুঁজে পাওয়া যায়; যেমন—১. গানের বাণী বা কাব্যাংশের মধ্যে শৃঙ্গার ও করুণ রসাত্মক চিন্তাধারার অভিব্যক্তি পদে পদে প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে; ২. নর-নারীর বা প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমের প্রকাশ; বিরহের রূপ বা স্বরূপ বর্ণন, বিরহ-মিলনের আকাঙ্ক্ষা নজরুলের ঠুমরিতে অপরিহার্য, যা প্রকৃত ঠুমরির আদলেই তৈরি; ৩. নজরুল রচিত ঠুমরিতে রাধা-কৃষ্ণের বিরহ-মিলন, কৃষ্ণের বংশীবাদন, শ্রীরাধিকার বিরক্তি অথবা উভয়ের হোলিখেলা প্রভৃতি রাধা-কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক বিভিন্ন ঘটনাও উপস্থাপিত হয়েছে; ৪. ঠুমরি গান পরিবেশনকালে আলাপ, স্বরবিস্তার ও বাণীবিস্তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, নজরুল ঠুমরিশৈলীতেও এ বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যায়; ৫. সওগাত ও করুণ রসাত্মক বা করুণ রসযুক্ত সুরের ওপর ঠুমরি আধারিত—নজরুলের ঠুমরিতেও সে বিষয়টি দৃশ্যমান।
তবে ঠুমরিগান প্রধানত দুই তুকবিশিষ্ট (স্থায়ী ও অন্তরা) হয়ে থাকে, কিন্তু নজরুলের ঠুমরিগান দুই থেকে চার তুকবিশিষ্ট। কারণ নজরুল সংগীতধারা বাংলা লঘু সংগীত শাস্ত্রীয় রাগসংগীত নয়, যেখানে সুরের আবেদন মুখ্য, বাণীর আবেদন গৌণ। আরেকটি অমিল খুঁজে পাওয়া যায় নজরুল ঠুমরিতে, যেটি প্রকৃত ঠুমরিশৈলীর বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা—সেটা হলো তাল ও লয়ের বিষয়টি। কারণ ঠুমরিগান দুইভাবে বিভক্ত—বিলম্বিত ঠুমরি ও দ্রুত ঠুমরি। নজরুল রচিত ঠুমরি দ্বিতীয় প্রকৃতির।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে নজরুলসংগীত সম্ভারে ঠুমরিগানের অবস্থান প্রকৃত ঠুমরি ঘরানার সব নিয়ম-নীতি মেনেই তিনি উপস্থাপন করেছেন, তবে নিজস্বতা বা স্বকীয়তা কিছু তো আছেই। এ কারণেই কাজী নজরুল রচিত ঠুমরিগান এক বিশেষ মর্যাদায় আজ অধিষ্ঠিত। স্বকীয়তায় নজরুলকে সবার থেকে এক ও অনন্য করে তুলেছে। সব শেষে নজরুল রচিত বেশ কয়েকটি ঠুমরি অঙ্গের রাগপ্রধান গানের উদাহরণ একটি করে লাইনের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো—১. না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়, ২. সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি, ৩. বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ, ৪. পরান প্রিয়! কেন এলে অবেলায়, ৫. গুণ্ঠন খোলো পারুল মঞ্জরী, ৬, কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া, ৭. এ কোন মায়ায় ফেলিলে আমায়, ৮. পিয়া গেছে কবে পরদেশ, ৯. পেয়ে কেন নাহি পায়, ১০. রহি রহি কেন সে মুখ পড়ে মনে।
এই গানগুলো ভালোভাবে শুনলে এবং পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে প্রকৃত ঠুমরির সব নিয়ম-নীতি মেনেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত ঠুমরি অঙ্গের গানগুলো সৃষ্টি করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম একজন বৈচিত্র্যময় ও সৃষ্টিশীল নূতনের অভিসারী। সে কারণে তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা নতুন কিছুর সংযোজন, পরিমার্জন, পরিবর্ধনের মাধ্যমে তিনি তাঁর সৃষ্ট ঠুমরিধারার গানগুলোকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। নজরুল মননে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটির প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় সেটি হলো পুরাতনের মাঝে, পুরাতনকে ভালোবেসে শ্রদ্ধায় ও সম্মানে নূতনের সংযোজন। তাইতো তিনি আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম, আমাদের প্রাণের কবি, আমাদের জাতীয় কবি। আজ তাঁর ১২৭তম জন্মদিনে তাঁরই সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তাঁকেই বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানাই।