প্রমত্তা পদ্মা। এক বিস্তীর্ণ জীবন। এখানে যেমন জলাভূমি রয়েছে, রয়েছে নলখাগড়ার বন, কর্দমাক্ত ভূমি, বালিয়ারি, বালু সৈকত, চরাঞ্চল, নদীতীর, প্লাবনভূমি। আবার রয়েছে এর শাখা নদী, উপ-শাখা নদী, খাল, বিল।
২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করে গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই অভয়ারণ্যের মোট এলাকা ১১৭.৭২ বর্গকিলোমিটার। এর চার ভাগের তিন ভাগ পানি এবং এক ভাগ স্থল। এর মধ্যে কোর এলাকা হিসেবে রয়েছে ৮১.১৯ বর্গকিলোমিটার আর বাফার এলাকা হিসেবে রয়েছে ৩৬.৩০ বর্গকিলোমিটার।
পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে যেসব এলাকা রয়েছে সেগুলো হলো-ভাগ্যকূল, বাঘড়া, মেদিনীমণ্ডল, কান্দিপাড়া, মাওয়া, কুমারভোগ, তেউতিয়া, পালের চর, পূর্ব নাওডোবা, নাওডোবা, কাঁঠালবাড়ি, মাতব্বরের চর, ঢংগীকান্দি, বান্দরখোলা, আড়িয়াল খাঁ নদীর মুখ, খালপাড়, নারিকেলবাড়ি। এখানে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১১২ প্রজাতির পাখি, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৮৯ প্রজাতির মাছ, ২০ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৯ প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক, ৩১২ প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্ম। পদ্মাপারের উল্লেখযোগ্য প্রাণী হলো শুশুক, শিয়াল, খাটাশ, উদবিড়াল, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, বেজি, ভোঁদড়, বাগডাশ, দেশি ও পরিযায়ী নানা রকমের পাখি। সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে গুইসাপ, দাঁড়াশ সাপ, খয়ে গোখরা, মেটে সাপ, ঢোঁড়া সাপ, টিকটিকি, গিরগিটি, অন্য কিছু জলচর সাপ, গাঙেয় কাছিম, সুন্দি কাছিম, কড়িকাইট্টা, হলুদ কচ্ছপ ইত্যাদি।
উভচর প্রজাতির মধ্যে রয়েছে কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ, ঝিঁঝি ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ। ইলিশ, পাঙ্গাশ, চিতল, আইড়, রিঠা ও বাঘাইড়সহ অনেক মাছ পাওয়া যায় এই পদ্মায়। পাখি প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বড় সরালি, পাতি সরালি, গাঙচিল, ভুবনচিল, তিলাবাজ, ধলাকাপাসি, পাকড়াকাপাসি, তুর্কিবাজ, শঙ্খচিল, কাঠঠোকরা, পাকড়া কাঠঠোকরা, বসন্ত বাউরি, হুদহুদ, নীলকণ্ঠ, ছোট মাছরাঙা, বড় পানকৌড়ি, ডাহুক, খয়রামাথা সুইচোরা, নীল লেজ সুইচোরা, সবুজ সুইচোরা, পাপিয়া, বউ কথা কও, আবাবিল, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, খোঁড়লে প্যাঁচা, ছোট কান প্যাঁচা, তিলাঘুঘু, রাজঘুঘু, হটটিটি, লাল লতিকা, ঝুঁটি শালিক, গাঙশালিক, টিয়া, বড় বগা, শামুকখোল, কসাই পাখি, বাংলা বাবুই, দাগি বাবুই, দেশি বাবুই ইত্যাদি। উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে জল পলাশ, হিজল, বরুন, কদম, কাশনল, বন তুলসী, খুদে বট, শতমূল, বুরোধান, ঝাউ, বিভিন্ন ঘাস, লতা ও গুল্ম রয়েছে।
কিন্তু পদ্মা ও পদ্মাপারের জীববৈবিচিত্র্যে প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী প্রমত্তা পদ্মা বিবর্ণ মরুভূমি হওয়ার পথে এগোচ্ছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য। পদ্মায় মাছের সংখ্যা কমে গেছে। মৎস্যজীবীদের এখন সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তারা বিকল্প পেশা খুঁজছে। নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ। বর্ষা মৌসুমে পানি এলেও নদী তা ধারণ করতে পারছে না। ফলে খরা সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষকরা পানির অভাবে ভুগছেন। পানির অভাবের কারণে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। পদ্মায় এখন আর সেই বিশাল জলরাশি নেই। নেই পদ্মাপারের বিশাল সব ক্ষেত-খামার, জঙ্গল বা বনভূমি।
বাসসের এক সংবাদে এ রকম আরো একটি চিত্র উঠে এসেছে। পদ্মা নদীতে নির্বিচারে কঠিন ও তরল বর্জ্য পদার্থ ফেলা হচ্ছে। একই সঙ্গে নদী দখলও ঘটছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে মাছ শিকার, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ও প্লাস্টিক দূষণের কারণে এখানকার মাছের বৈচিত্র্যও হ্রাস পাচ্ছে। অবৈধ দখল, প্লাস্টিক ও বর্জ্য পদার্থের দূষণ চলতে থাকলে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি সংবাদের তথ্যমতে, অন্তত ৬০০ দখলদারের কবলে পদ্মা নদীপার। এখানে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে রাস্তা। যে যার মতো দখল করছে। বানানো হচ্ছে রেস্টুরেন্ট, নানা রকমের দোকান ও বিনোদনকেন্দ্র।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি পত্রিকার সংবাদের তথ্য মতে, পদ্মায় পানি কমেছে ৭১ শতাংশ। এক সময়কার প্রমত্তা বলে কথিত পদ্মার গর্জন এখন শুধুই গল্প। ফলে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে পদ্মাকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা জীববৈচিত্র্য। যদিও সরকার অভয়ারণ্য তৈরি করেছে। কিন্তু আগের মতো নেই শিয়ালের ডাক। শুশুক, বাগডাশের তো দেখাই পাওয়া যায় না। পদ্মার নামে পরিচিত ও বিখ্যাত সেই পদ্মার ইলিশও কমতে শুরু করেছে। তাই আসুন পদ্মাকে বাঁচাই। পদ্মাকে বাঁচাতে আমাদের সচেতন হতে হবে সবাইকে। শুধু ২২ দিনের পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিলে চলবে না। আশপাশের দখল-দূষণ রোধ করা থেকে শুরু করে নদী খনন, জলপ্রবাহ সবই আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। হয়তো এভাবেই ফিরিয়ে আনা যাবে ধীরে ধীরে প্রমত্তা পদ্মাকে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক