• বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫, ১২:৩৫ অপরাহ্ন

ইসলাম ধর্মে কোরবানির মর্মকথা

নিজস্ব প্রতিবেদক / ৪৯ টাইম ভিউ
আপডেটঃ মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫

ইসলামের দর্শনে কোরবানির মর্মার্থ শুধু পশু জবাই নয়, বরং আত্মোৎসর্গ, খালেস নিয়ত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। কোরবানি হলো এক বিস্তৃত আত্মত্যাগের প্রতীক।

১. ঈমান হলো আত্মার কোরবানি

২. নামাজ ও রোজা হলো দেহ ও শারীরিক শক্তির কোরবানি

৩. জাকাত হলো সম্পদের কোরবানি

৪. জিহাদ হলো সময়, মেধা ও দেহ-মনের কোরবানি

৫. আর আল্লাহর পথে যুদ্ধ হলো জীবন উৎসর্গের পরাকাষ্ঠা।

এভাবেই আল্লাহ তাআলা আমাদের ওপর পশু কোরবানির বিধান ফরজ করেছেন, যেন আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর নিয়ামতের স্বীকৃতি দিই এবং নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধা ও ভক্তির মাধ্যমে তাঁর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করি।

 

 

সব আসমানি ধর্মে কোরবানির অস্তিত্ব

মানবজাতির ইতিহাসে কোরবানি শুধু ইসলামেই নয়, বরং পূর্ববর্তী প্রায় সব আসমানি শরিয়তে কোনো না কোনোভাবে কোরবানির বিধান ছিল। পবিত্র কোরআনে আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানির ঘটনা তার স্পষ্ট প্রমাণ : ‘যখন তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল করা হলো এবং অপরজনেরটি প্রত্যাখ্যান করা হলো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২৭)

 

পূর্ববর্তী শরিয়ত ও ইসলামে কোরবানির বিধানে মৌলিক পার্থক্য

১. কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থানের

বিধান : ইসলামের আগের অনেক শরিয়তে কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত ছিল। যেমন—ইহুদি ধর্মমতে, কোরবানির পশু উৎসর্গ করার একমাত্র বৈধ স্থান ছিল ‘হায়কালে সুলাইমানি’, যা বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত।

এর বাইরে অন্যত্র কোরবানি বৈধ ছিল না। 

(তালমুদ, Tractate Zebahim)

ইসলামে যদিও কোরবানির মূল কেন্দ্রস্থল হিসেবে মিনাকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে (বিশেষত হজে অংশগ্রহণকারীদের জন্য), তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং খুলাফায়ে রাশিদিন কোরবানিকে একটি সর্বজনীন ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। আজ পুরো দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে আল্লাহর নামে পশু জবেহ করে কোরবানির ইবাদত পালন করা যায়। এটি ইসলামের বৈশ্বিকতা ও সহজতার পরিচায়ক।

 

২. কোরবানির অধিকার ও অংশগ্রহণ : আগের শরিয়তগুলোতে সাধারণ মানুষ কোরবানিতে সরাসরি অংশীদার হতে পারত না, বরং পুরোহিত শ্রেণির নির্ধারিত ব্যক্তিরাই (যেমন—ইহুদিদের ‘কোহেন’ বা ‘লেবীয়’ জাতি) পশু উৎসর্গ করতেন। কোরবানিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক, মাঝারি শ্রেণিনির্ভর ইবাদত হিসেবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল।

ইসলাম এই প্রথার অবসান ঘটিয়ে কোরবানিকে করে তুলেছে জনগণের ইবাদত, সরাসরি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদিত একটি আত্মিক ও আর্থিক ত্যাগের অনুশীলন। প্রত্যেক মুসলমান, সে ধনী হোক বা গরিব, পুরুষ বা নারী, স্বাধীনভাবে নিজ হাতে কোরবানি করতে পারে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে কোরবানির পশু জবেহ করতেন এবং উম্মতকেও তাতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) দুটি সাদা-কালো রঙের ভেড়া দ্বারা কোরবানি করেছেন। তখন আমি তাঁকে দেখতে পেলাম—তিনি ভেড়া দুটির পার্শ্বে পা রেখে ‘বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার’ পড়ে নিজ হাতে সে দুটিকে জবেহ করেন। 

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৫৫৮)

 

কোরবানির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য

মানবজাতির ইতিহাসে কোরবানি এক চিরন্তন আধ্যাত্মিক প্রথা, যার মূল নিহিত আছে আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণ এবং ঈমানের শুদ্ধ প্রতিফলনে। তবে ইসলাম এই প্রথাকে যেভাবে পরিশুদ্ধ, মানবিক ও সর্বজনীন ইবাদতে রূপান্তর করেছে, তা পূর্ববর্তী কোনো ধর্মে এতটা ব্যাপক ও দয়া-ঘন হয়ে প্রতিভাত হয়নি।

বহু পূর্ববর্তী ধর্ম ও শরিয়তে কোরবানির গ্রহণযোগ্যতার একটি বাহ্যিক ও অলৌকিক চিহ্ন নির্ধারিত ছিল। জনসমক্ষে কোরবানি পেশ করা হতো খোলা মাঠে। তারপর আসমান থেকে যদি কোনো অগ্নিশিখা নেমে এসে সেই কোরবানিকে গ্রাস করত, তবে সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে কবুল হিসেবে গণ্য হতো। পক্ষান্তরে যে কোরবানিকে সেই আগুন স্পর্শ করত না, তা প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। এই অলৌকিক ব্যবস্থার কথা পবিত্র কোরআনেও এসেছে : ‘(এরা) সেই লোক, যারা বলে, আল্লাহ আমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে আমরা কোনো নবীর প্রতি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান আনব না, যতক্ষণ না সে আমাদের কাছে এমন কোনো কোরবানি উপস্থিত করবে, যাকে আগুন গ্রাস করবে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৩)

আগের ধর্মে কোরবানির এই নিয়ম ছিল যে কারো কোরবানি কবুল হলে, আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত। আর যার কোরবানি কবুল হতো না তা পড়ে থাকত। অথচ ইসলাম এই বাহ্যিকতা থেকে মুক্ত করে কোরবানিকে ইখলাস ও অন্তরের আন্তরিকতার ভিত্তিতে মূল্যায়নের উপযোগী করে তোলে।

কোরআন কারিমে স্পষ্ট ঘোষণা করা

হয় : ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না তাদের গোশত, না তাদের রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা : আল হজ, আয়াত : ৩৭)

 

উৎসর্গের সঙ্গে উপকারভোগের অধিকার

পূর্ববর্তী বহু ধর্মীয় বিধানে কোরবানির পশু উৎসর্গ করার পর তা থেকে কোনো উপকার নেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল। সেই পশুর গোশত, চামড়া বা হাড় কিছুই মানুষের ব্যবহারের জন্য বৈধ ছিল না। কোরবানিকে কেবল নিছক একটি নিঃস্বার্থ দান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যার সঙ্গে পার্থিব কোনো লাভের সম্পর্ক রাখা যেত না। কিন্তু ইসলাম এই কঠোরতা থেকে উম্মতকে মুক্ত করে দিয়েছে। কোরবানিকে করে তুলেছে একাধারে ইবাদত, ত্যাগ এবং সমাজকল্যাণের এক সুবাসিত সঙ্গম। একদিকে যেমন এতে রয়েছে ইলাহি সওয়াব ও নৈকট্য, তেমনি রয়েছে নিজে খাওয়ার, পরিবারকে খাওয়ানোর এবং গরিব-মিসকিনদের তৃপ্ত করার বৈধতা ও উৎসাহ। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন : ‘যখন (কোরবানির) পশুগুলো ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে, তখন তোমরা নিজেরাও খাও, আর খাওয়াও তাদেরও, যারা অভাবগ্রস্ত এবং তাদেরও, যারা নিজ অভাব প্রকাশ করে।’

(সুরা : হজ, আয়াত : ৩৬)

এই আয়াত শুধু বৈধতার অনুমোদন নয়, বরং একটি সামাজিক ন্যায়বিচার, আত্মিক সংবেদনশীলতা ও দরিদ্রমুখিনতার এক অপূর্ব ঘোষণা।

 

জাতীয় উন্নয়নে কোরবানি

কোরবানি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি জাতির আত্মা, সংগ্রামের জ্বালানি এবং বিজয়ের পাথেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন কোনো জাতি দুনিয়ার নেতৃত্বের উপযুক্ত নয়, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজন হলে নিজের জান, মাল, সময়—সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়।

মোটকথা, ইসলামে কোরবানি শুধুই একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি আত্মশুদ্ধির অনুশীলন, অন্তরের অহংকার ধ্বংসের পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি এবং মানবিক সহানুভূতির উদ্ভাস।

 

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া মাদানিয়া

শুলকবহর, চট্টগ্রাম

 

 

 


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এই বিভাগের আরো খবর