• রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫, ১১:১৩ অপরাহ্ন

বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন

নিজস্ব প্রতিবেদক / ৯২ টাইম ভিউ
আপডেটঃ রবিবার, ১১ মে, ২০২৫

মহাকারুনিক তথাগত বুদ্ধের ধর্মের বহুবিধ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তিনি যে অমৃতময় মহান ধর্ম প্রচার করেছেন, তা কোনো ঈশ্বরের বাণী নয়, কিংবা কোনো একটা বিশেষ মতবাদও নয়, অথবা কোনোরূপ কাল্পনিক ধর্মমতও নয়। এই ধর্ম বুদ্ধ আড়াই হাজার বছর পূর্বে কঠোর সাধনায় প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মাধ্যমে অধিগত করেছিলেন এবং সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে দিকে দিকে প্রচার করেছিলেন। রাজকুমার সিদ্ধার্থ সব কিছু ত্যাগ করে সুদীর্ঘ ছয় বছর সাধনার দ্বারা লব্ধ এই অগ্নিবাণী কখনো ব্যর্থ হওয়ার নয়, নয় তা দেশ-কালের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এই সত্যের উত্তরাধিকার সব মানুষের, সব দেশের, সব যুগের। 

প্রতিটা মানুষের মধ্যে এমন কিছু প্রতিভা লুকায়িত আছে বা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যা বিকশিত করতে পারলে অথবা জাগিয়ে তুলতে পারলে সাধারণ মানুষ অসাধারণে পরিণত হতে পারেন। নিজের চেষ্টার মাধ্যমে সবাই জ্ঞানী ও আলোকিত হতে পারেন।

আমরা যদি তথাগত বুদ্ধের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসে গড়া একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন।

তাঁর মধ্যেও অন্য দশজনের মতো নানা রকম সন্দেহ-সংশয় ছিল। যেমন আমি কেন বারবার জন্মধারণ করি? আমার এ দেহ কে তৈরি করেন, মানুষ কেন এত দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেন? তাঁর অতীত জন্মে বোধিসত্ত্বাবস্থায় এ রকম নানাবিধ ভ্রান্তধারণা মনের মধ্যে বারবার উঁকি দিত। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন একজন মহাশক্তিমান কেউ আছে কি যে আমাকে বারবার জন্মধারণ করতে সাহায্য করেন? তিনি মনের মধ্যে এ রকম ভ্রান্তধারণাকে পোষণ করে সেই গৃহকারককে জন্মজন্মান্তর পর্যন্ত দেশ-দেশান্তরে, পথে-প্রান্তরে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন। সময়ক্ষেপণ করেছেন কল্পকাল, কিন্তু তিনি তার সন্ধান পাননি।
পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে পরিণামে পেয়েছেন শুধুই দুঃখ। সে দুঃখসমূহ কী? জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, ঈপ্সিত বস্তু অলাভজনিত দুঃখ, সংক্ষেপে পঞ্চোপাদান স্কন্ধ দুঃখ। 

সর্বোপরি তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে আমাকে জন্ম-মৃত্যু ও দুঃখসমূহের মূল রহস্য উদঘাটন করতেই হবে। তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে এক আষাঢ়ী পূর্ণিমার গভীর নিশিতে সুন্দরী স্ত্রী যশোধরা, নবজাত পুত্র রাহুল, পিতা রাজা শুদ্ধোদন, বিলাসব্যসন, রাজসিংহাসন, রাজ্য সব কিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত অবলম্বনের মাধ্যমে বেছে নিলেন কঠিন সাধনার পথ। একাধারে ছয় বছর সাধনা করে অবশেষে গয়ার বোধিদ্রুম মূলে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সমস্ত মারসৈন্যকে পরাভূত করে বুদ্ধত্ব বা সম্বোধি লাভ করতে সমর্থ হলেন।

বুদ্ধত্ব লাভের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে সমগ্র জগতের বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি-অন্ত গূঢ়রহস্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান (সম্যক প্রজ্ঞা) অধিগত করতে সক্ষম হলেন। তারপর তিনি বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘যাকে খুঁজে খুঁজে কল্পকল্পান্তর সময় অতিক্রান্ত করেছি, অনন্তকাল দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেছি, আজ আমি সত্যি সত্যি তোমার সন্ধান পেয়েছি। হে গৃহকারক তোমার সব ধরনের নির্মাণ উপকরণ, গৃহচূড়া (লোভ, দ্বেষ, মোহ কিংবা সমস্ত তৃষ্ণা) আমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছি। তুমি পুনরায় আমার এ দেহ নির্মাণ করতে পারবে না অথবা আমাকে পুনরায় জন্মধারণ করাতে সমর্থ হবে না—এটাই আমার শেষ জন্ম। লোভ, দ্বেষ, মোহকে এককথায় বলা হয় ‘তৃষ্ণা’। আমি সব তৃষ্ণা ক্ষয় করে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গে সর্ব দুঃখের অন্তসাধন করেছি, নির্বাণ সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হয়েছি। বুদ্ধ এ কথাই দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, তৃষ্ণাই হচ্ছে পুনর্জন্মের মূল কারণ। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু সব দুঃখের প্রধান কারণ হলো নিজের লোভ, দ্বেষ, মোহ বা তৃষ্ণা। 

বুদ্ধ হলেন মুক্ত পুরু, পূজা-বন্দনার অতীত। পূজা হলো ত্যাগের মহিমা বিকাশের প্রক্রিয়া এবং বন্দনা বুদ্ধের গুণ-মহিমা অনুস্মরণ করার প্রক্রিয়া বিশেষ। এসব পূজা দুঃখমুক্তির জন্য যে নিতান্ত প্রয়োজন তা নয়। তবে এ পূজা-বন্দনা মানুষের পাপচিত্তকে সাময়িকভাবে হলেও শান্ত, পবিত্র করতে সহায়তা করে। মানুষের চিত্ত সতত লোভ, দ্বেষ, মোহ ইত্যাদি পাপধর্মে লিপ্ত থাকে। বন্দনা ও পূজার মূল উদ্দেশ্য হলো দুঃখমুক্তির সত্যদ্রষ্টা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। ধর্ম হলো দুঃখমুক্তির সেই একমাত্র পথকে অনুসরণ এবং সংঘ হচ্ছেন সেই জীবন্ত মুক্তি-পথযাত্রীর অনুগমন। বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘকে পূজা করলে তাঁরা মুক্তি এনে দেবেন, এটা কোনো বৌদ্ধ বিশ্বাস করেন না। মুক্তি নিজের চেষ্টায় রচনা করতে হবে। তাই অলৌকিক শক্তির ওপর বিশ্বাস স্থাপন না করা বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বুদ্ধ বলেন, ‘He honours me best who practice my teaching best. He who sees the Dhamma, sees me.’

বুদ্ধপূর্ণিমা : রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, তাঁর বুদ্ধত্ব লাভ ও বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ। বুদ্ধ জীবনের এ তিনটি প্রধান ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল বলে বৌদ্ধবিশ্বে এ পূর্ণিমাকে বুদ্ধপূর্ণিমা নামে অভিহিত করা হয়। জাতিসংঘ বৈশাখী পূর্ণিমাকে ‘আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে’ নামে পালন করে থাকেন।

রাজা শুদ্ধোদন ও রানি মহামায়ার ঔরসে কুমার সিদ্ধার্থের জন্ম না হলে জগতে বুদ্ধের উৎপত্তি হতো না, জগতে বুদ্ধের উৎপত্তি না হলে জগৎ মহান্ধকারে নিমজ্জিত থাকত এবং মানুষ দুঃখের কশাঘাত থেকে  কখনো মুক্তি লাভ করতে পারত না। তাই সমগ্র পৃথিবীতে বৈশাখী পূর্ণিমার গুরুত্ব অত্যধিক।

সমগ্র জগৎ বুদ্ধপূর্ণিমার আলোয় উদ্ভাসিত হোক। পৃথিবী আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে পরিপূর্ণতা লাভ করুক। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ, ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন, লেখক ও সংগঠক


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এই বিভাগের আরো খবর