চৈত্রের দুপুর, কাঠফাটা রোদে গাছের ছায়া তলে কিছুটা প্রশান্তি পাওয়া যায়। কোকিলের কুহু ডাক, ঘুঘুর বিচরণে চড়ইয়ের ঝাক এবং ফুলের মিষ্টি গন্ধ—এমন প্রকৃতির মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত সুরেলা সঙ্গীত বেজে ওঠে। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মেট্রোপলিটন শহরের কনক্রিটের মাঝে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু খুলনার মুজগুন্নি এলাকায় গিয়ে যদি আপনি একটু চোখ মেলে তাকান, তবে দেখতে পাবেন গ্রামবাংলার এক অপরূপ সৌন্দর্যের মিলনমেলা। এ এলাকার মাঠজুড়ে শুধু সূর্যমুখির স্বর্ণালী ফুলের মেলা। এটি যেন এক বর্ণিল উৎসবের শুরু, যেখানে প্রকৃতি তার রং আর রূপের খেলা দেখায়।
এ এলাকার কৃষকরা প্রতিবছর সূর্যমুখি ফুলের চাষাবাদ করেন। কৃষি অফিসের সহায়তায় তাদের এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়েছে। এবার, যদিও কিছুটা দেরিতে সূর্যমুখি ফুল ফুটেছে। তবে তাদের সৌন্দর্য মুগ্ধকর। ফুলগুলি উজ্জ্বল হলুদ, সোনালি রঙে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। তাদের সোজা দাঁড়িয়ে থাকা গঠন, সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা, সত্যিই এক নতুন জীবনের অনুভূতি এনে দেয়। এর রূপ যেন চোখে পরলেও মন থেকে সরে না।
প্রতিদিনই এখানে তরুণ-তরুণীরা দলবদ্ধ হয়ে ছবি তুলতে আসেন। গাছের নিচে বসে তাজা বাতাসে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সূর্যমুখি ফুলের সামনে দাঁড়িয়ে তারা অবিরাম হাসিতে মগ্ন হয়ে ওঠেন। তাদের উল্লাসে জায়গাটি যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
এখানে সূর্যমুখি ফুলের চাষাবাদ শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্যই নয়। এটি কৃষকদের জীবিকার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূর্যমুখি তেল উৎপাদন এবং ফুলের ব্যবসা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। কৃষকদের দাবি, এমন ফসলের চাষে তাদের লাভবান হওয়ার পাশাপাশি এলাকার জনসাধারণও এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে।
এ অঞ্চলের পরিবেশ, প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে এক চমৎকার সম্পর্ক দেখা যায়। প্রকৃতির এই রূপ শুধু শহরের বাসিন্দাদের জন্য নয়, স্থানীয় কৃষকদের জন্যও এক ধরনের আশীর্বাদ। সূর্যমুখি ফুলের মেলা প্রতিবছর স্থানীয় জনগণের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই এখানে নতুন দর্শক আসে, ছবি তোলে এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে।
খুলনা নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রাফিজা খানম জানান, প্রতিবছর এ এলাকায় সূর্যমুখির চাষাবাদ হয়। আমরা মুখিয়ে থাকি কখন ফুটবে সেই ফুল। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝিতে ফুল ফোটে। কিন্তু এবার মার্চের মাঝামাঝিতে ফুল ফুটেছে। অনেক রোদ তারপরও এই বাগানে আসলে আনন্দে রোদ লাগে না।
নগরীর ছোট বয়রা মিতালী কলোনি এলাকার কৃষক আসাদুজ্জামান (নয়ন) জানান, কৃষি অফিস থেকে বীজ, সার পেয়ে আমি সূর্যমুখির চাষাবাদ করি। যদিও এবার অনেক দেরী হয়েছে। তারপরও ফলন বেশ ভাল। এই বীজ এবং সূর্যমুখি তেলের চাহিদা রয়েছে অনেক। এবার ফলন আমার প্রত্যাশা পূর্ণ করেছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন (লবণচরা) কৃষি অফিসের কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফরহদীবা শামস জানান, এটি যেমন প্রকৃতির এক সৌন্দর্য প্রকাশ, তেমনি মানুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাও বৃদ্ধি করে। এই সূর্যমুখি ক্ষেতগুলোর মাঝে হারিয়ে যাওয়া কেবল সৌন্দর্য নয় বরং এটি একটি পরিবেশগত শিক্ষা যে, প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক কখনোই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। আমরা কৃষকের মাঝে টিএসএফ-২৭৫ জাতের বীজ, সার প্রদান করি। কৃষক সেই বীজ থেকে এই বাগান উপহার দিয়েছে। যদিও এবার অনেক দেরীতে ফুটেছে সূর্যমুখি।
মুজগুন্নি এলাকার সূর্যমুখির ফুলের ক্ষেতে যাওয়ার পর, আপনি শুধু একটি ফুল দেখতে পাবেন না, পাবেন একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা—এটি প্রকৃতির একটি অপূর্ব নিদর্শন। যা আপনার মনে নতুন এক শান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করবে।