ছোটবেলায়ই একবার মানিক হলদি নদীর পাশের এক বিলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কাদায় ডুবে মারা যাচ্ছিলেন বলা যায়। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য আসছে না। এমন সময় হঠাৎ দূর থেকে একজন মুসলমান কৃষক মানিকের এই ডুবে যাওয়া দেখে তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলেন। অনেক কষ্টে তাঁকে টেনে তুললেন কাদা থেকে।
অদূরে রন্ধনরতা রসুলের বোন নসিরনকে দেখিতে দেখিতে কুবের মনে মনে একটু আফসোস করিল। ভাবিল, কি ক্ষতি মুসলমানের হাতে রান্না খাইলে? ডাঙ্গার গ্রামে যাহারা মাটি ছানিয়া জীবিকা নির্বাহ করে তাদের মধ্যে ধর্মের পার্থক্য থাকে থাক। পদ্মা নদীর মাঝিরা সকলে এক কর্মী। গণেশ, শম্ভু ওরা সঙ্গে না থাকিলে কুবের তো নিজের জন্য রাঁধিতে বসিত না।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যাপিত জীবনে জগত্সংসারে জীবন যাপন করতে করতে যেন হাঁপিয়ে উঠতেন। তাই প্রায়ই ঘর ছেড়ে বাইরে ছুটে যেতেন।
কিশোর বয়স থেকেই খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারতেন মানিক। বাঁশি ছিল সে সময় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। বাঁশি হাতেই টাঙ্গাইলের ক্ষেতখামারে কিংবা নদীর ধারে একা একাই ঘুরে বেড়াতেন। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুখ-দুঃখের গল্প। গল্পে এতটাই বিভোর হয়ে যেতেন যে বাড়ি ফিরতে বেমালুম ভুলে যেতেন। জীবন যাপন করতে থাকেন সেইসব মাঝিমাল্লার সঙ্গে। সেই নৌকায়ই কেটে যায় পর পর কয়েক দিন। পরিণত বয়সে এই মানুষটির হাতেই যে রচিত হবে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মতো উপন্যাস, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘এই জীবন আমার আপন অথচ এই জীবন থেকেই মাঝে মাঝে পালিয়ে ছোটোলোক চাষাভুষোদের মধ্যে গিয়ে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি। আবার ওই ছোটোলোকদের অমার্জিত রিক্ত জীবনের রুক্ষ কঠোর নগ্ন বাস্তবতার চাপে অস্থির হয়ে নিজের জীবনে ফিরে এসে হাঁফ ছাড়ি।’ মানিক তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দোলখেলার জন্য বাঁশঝাড় থেকে পিচকিরির বাঁশ কাটতে গেলেও মুসলমান কৃষকরা মানিকের এই অত্যাচারকে স্নেহের চোখেই দেখতেন। এ ছাড়া স্কুলের পরে পালোয়ান শিবলোচন সিং ও নারায়ণ সিংয়ের কাছে কুস্তি শিখতেন তিনি। তাঁদের উচ্ছ্বসিত বাহবাও পেতেন। একবার ছোট ভাই নালুকে (সুবোধ) গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একক মারামারিতে তাদের পরাস্ত করেছিলেন। পাড়ায় কোথাও আগুন লাগলে স্কুলের নিয়ম ভেঙেই তিনি যোগ দিতেন আগুন নেভানো দলের প্রথম সারিতে। যমুনার চর থেকে যে ছোট নৌকাগুলো টাঙ্গাইল বাজারে দুধ নিয়ে আসত, সেগুলো দখল করে মানিক বন্ধুদের সঙ্গে ভরা বর্ষার নদীতে বাইচ খেলতে যেতেন। মাঝেমধ্যে নৌকার মালিকদের সঙ্গে এ নিয়ে বিবাদ লাগলেও এইসব মানুষের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে বিবাদ বেশিদূর গড়াত না। (একটি জীবনী, মালিনী ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা-৪৪)
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনা, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) লৌহজং অঞ্চলের গাওদিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মের সময় তিনি ঝাড়খণ্ডে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পোশাকি নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। পিতার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটলমেন্ট বিভাগের সাবরেজিস্ট্রার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দুমকা, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি অঞ্চলে। মা নীরদাসুন্দরীর আদি নিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের লৌহজংয়ের গাওদিয়া গ্রামে। সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি আর এই গ্রামটির পটভূমিতেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিহার ও অবিভক্ত বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নানা সময়ে অন্তত ১০টি স্কুলে পড়েছেন। টাঙ্গাইল অঞ্চলে বসবাসকালে তিনি ক্লাস সেভেনে পড়তেন, এ কথা নিজেই লিখেছেন ‘বড় হওয়ার দায়’ গল্পে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কেন এত জনপ্রিয়? এর কারণ সম্ভবত তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্ক্সীয় শ্রেণিসংগ্রামতত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা তাঁর রচনায় ধরা পড়েছে। সে কথা তিনি নিজেও অকপটে স্বীকার করেছেন—‘লেখালেখির শুরুতে আমি বিশ্বখ্যাত মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েড দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমার শুরুর দিককার সবগুলো লেখাতেই কোনো না কোনোভাবে অস্ট্রীয় এই মনস্তাত্ত্বিকের ছাপ থাকতো। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ দিয়ে মানুষ ও সমাজকে বিশ্লেষণ করতাম আমি। কিন্তু সমাজের সবকিছুর সমাধান ফ্রয়েড দিতে পারেননি। তাই একটা সময়ে এসে আমি বাঁক বদল করতে বাধ্য হই। আমি তখন আশ্রয় নেই বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্সের। মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হয়ে আমি তখন লিখতে শুরু করি আমার পরবর্তী রচনাগুলো। তবে অনেকের মতে, আমি কখনো কখনো ফ্রয়েড ও মার্ক্সকে সমন্বয় করেছি আমার লেখায়। সে কথাও মিথ্যা নয়।’
ডানপিটে ও দুরন্তপনার সঙ্গে বই পড়ায়ও মানিকের ছিল সমান আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্রসহ তাঁর সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ সব লেখকের লেখা তিনি পড়তেন বিশেষ আগ্রহ নিয়ে। বিশেষ করে শরত্চন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’ প্রভৃতি ছিল তাঁর প্রিয় উপন্যাস। পাঠক হিসেবেও মানিক ছিলেন অসামান্য। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি তিনি একবার-দুবার নয়, বহুবার পড়েছেন। সে কথা নিজেই তাঁর আত্মস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন। আসলে ভাবীকালে যাঁরা জগদ্বিখ্যাত হবেন, তাঁরা বোধ করি এ ধরনের নিবিষ্ট পাঠকই হন। তা না হলে লিখিয়ে হবেন কি করে। আমার এই বক্তব্যের সপক্ষে বলতে গেলে বলতে হয়, জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসক ইবনে সিনা অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’ বইটি কম করে ৪০ বার পড়েছিলেন। বইটি তাঁর মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল বলা চলে। তার পরও বইটির অনেক তত্ত্বই তাঁর বোধগম্য হচ্ছিল না। পরবর্তীকালে উপায়ান্তর না পেয়ে তিন দিরহাম দিয়ে তিনি আল-ফারাবির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ কিনে এর পাঠ উদ্ধার করেছিলেন। ঠিক তেমনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের পুরো ‘গীতবিতান’ মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক উপন্যাসই তাঁর মুখস্থ ছিল। মহাবীর আলেকজান্ডার ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ মহাকাব্য দুটি পড়তে পড়তে একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। সেই বই দুটি তিনি অনুসরণ করে তাঁর জীবনের সব যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি—গ্রিক ও পার্সিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। গ্রিক বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলেকজান্ডার। যেদিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা, অর্থাৎ ১ অক্টোবর ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকজন সেনাপতি ও সঙ্গী-সাথি আলেকজান্ডারের তাঁবুতে এসে হাজির। সেখানে পৌঁছতেই তাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না; কারণ তখনো আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন আলেকজান্ডার। গভীর ঘুমে ব্যাপৃত আছেন তিনি। সবাই মিলে তাঁবুর বাইরে পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে আলেকজান্ডারের এক বন্ধু ও সেনাপতি পারমেনিও বেশ কয়েকবার ডেকে জাগালেন তাঁকে। ভ্রু কুঁচকে পারমেনিও আলেকজান্ডারকে উদ্দেশ করে বললেন—বলুন তো এও কি সম্ভব! এমন একটি সাংঘাতিক ও ঘোরতর যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েও আপনি কী করে নিরুদ্বেগে ঘুমাচ্ছেন? আলেকজান্ডার মৃদু হেসে উত্তর দিলেন—আমরা তো জয়ী হয়েই আছি। পারমেনিও দ্বিগুণ বিস্ময়ে বললেন—সে কিভাবে? আলেকজান্ডার তক্ষুনি বালিশের নিচ থেকে হোমারের ‘ইলিয়াড’ বইটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বললেন—এই বইটা ভালো করে দেখো। এটা আমার প্রায় মুখস্থ বলতে পারো। এই বইয়ে লিখিত প্রতিটি যুদ্ধকৌশল আমার নখদর্পণে। তবু ভাবছ দারিয়ুস জিতবে এই যুদ্ধে?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনের এই অতি ক্ষুদ্র পরিসরেও রচনা করেছেন ৪০টি উপন্যাস এবং তিন শর মতো ছোটগল্প। তাঁর রচিত ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং ‘অতসী মামী’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘হারানের নাতজামাই’, ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ ইত্যাদি গল্প সংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ইংরেজি ছাড়াও তাঁর রচনাগুলো বহু বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।