ভাইয়ের (মুস্তাফা জামান আব্বাসী) পাশে গত বৃহস্পতিবার অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। মনটা খুব খারাপ। ভাইয়ের মুখে কথা নেই। আমি বললাম, বউ চলে গেল (ভাবিকে আমি বউ বলে ডাকতাম)। রেজাও চলে গেল আমাকে কিছু না বলে (আমার স্বামী রেজাউর রহমানের ডাকনাম)। তোর কী ইচ্ছা? আমরা একটা কাজ করতে পারি। তুই আর আমি হাত–ধরাধরি করে টুক করে বলরামপুর কোচবিহার চলে যাই। দার্জিলিং চলে যাই। কাউকে কিছু বলব না। কেউ আমাদের খুঁজেও পাবে না।
কথাটা শুনে ভাই নড়ল–চড়ল। মনে হলো, কথাটা ওর মনের গভীরকে স্পর্শ করেছে। সে তাকাল আমার দিকে। হাত দুটো ওপরে তুলে আমার মুখ ধরার চেষ্টা করল। আমিই ওর একটা হাত ধরলাম। সেই ছিল ওর সঙ্গে শেষ কথা।

কয়েক দিন আগেও একবার ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন অনেক দুষ্টুমি করছিলাম। বলেছিলাম, চল দাদা, ‘নদীর কূল নাই’ গাই, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’ গাই। আমি আসলে ওর মন কিছুটা ভালো করে দিতে চাইছিলাম। আমার কথা শুনে সে নড়াচড়া করছিল। বুঝতে পারলাম, তার ভেতরটা নড়েচড়ে উঠছে।
আমাদের বয়সের ব্যবধান দুই-আড়াই বছর। দুজনই পিঠাপিঠি দুই ভাইবোন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে বয়সের বেশি ব্যবধান বলে দূরত্ব রেখে চলতাম। আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম বলে খুবই দুষ্টুমি করতাম। মারামারি হতো, ঝগড়াঝাঁটিও হতো। ভাই আমাকে মাঝেমধ্যে ব্যথাও দিত। আর মায়ের কাছে এ কারণে শাস্তিও পেত। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল দারুণ। ছোটবেলায় হাত–ধরাধরি করে চলতাম কোচবিহারের এখানে–সেখানে, কত জায়গায়।
মানুষ হিসেবে আব্বাসী ভাই ছিল অতুলনীয়। অসুখ হওয়ার আগপর্যন্ত সারা জীবন বাজারসদাই আমি নিজেই করতাম। বাজারে গেলে দোকানদারেরা বলত, ‘আব্বাসী সাহেব আপনার ভাই হয় না? ওনার মতো মানুষ হয় না।’
বড় হয়ে আমরা চলে এলাম ঢাকায়। আব্বা আব্বাসউদ্দীন বলতেন, ‘মির্না মা, এই সিনেমাটা ভালো, তুমি আর তুলু মিলে দেখে আসো।’ আমার ডাকনাম মির্না, বড় ভাই সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের ডাকনাম দুলু, আর মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ডাকনাম ছিল তুলু।
আমরা দুই ভাইবোনই পড়াশোনায় বৃত্তি পেতাম। বাসা থেকে দুই ভাইবোন হাত–ধরাধরি করে প্রায়ই চলে যেতাম গুলিস্তান অ্যাভিনিউতে। সেখানে বেশ কিছু খাবারের দোকান ছিল। বৃত্তির টাকায় আমরা চপ–কাটলেট খেতাম।
আমরা বড় হচ্ছি। আব্বাসী ভাইও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। আমিও কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। একসঙ্গে গান করেছি মঞ্চে—এস এম হলে, এফ এইচ হলে। আমি মেয়েদের হলেও অনুষ্ঠান করেছি। আব্বাও কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমাদের দুজনকে নিয়ে যেত। বলত, ‘মাগো, চলো। তোমরা উচ্চাঙ্গসংগীত গাইবে।’ আমরা দুই ভাইবোন একই ওস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখছিলাম। আব্বা খুব চাইত আমরা দুই ভাইবোন উচ্চাঙ্গসংগীত গাই। খুব উপভোগ করত। আমরা আধুনিক গান, পল্লিগীতি এসবও গাইতাম।
একসময় ছায়াছবিতে গাইতে শুরু করলাম। সুভাষ দত্ত আর কবরী অভিনীত সুতরাং ছবিতে আমি আর ভাই দুজনে মিলে গান গাইলাম, ‘নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরও বাঁকা তোমার ছলনা।’
আমাদের মধ্যে দুষ্টুমির সম্পর্ক থাকলেও আব্বাসী ভাই আমার ব্যাপারে ছিল অতি যত্নশীল। মির্না কী করবে? কোথায় যাবে? এই কাজটা পারবে তো? একটা বোনই তো ছিলাম। তাই সে কখনো বন্ধু, কখনো আবার অভিভাবকও। বড় ভাই দুলুও অভিভাবকের মতো ছিল। পরে যখন বড় হলাম, আমার কোনো অসুখ-বিসুখ হলে দুই ভাই পাশে দাঁড়িয়ে যেত। আমি বেশ ঘন ঘন অসুস্থ হতাম। শেষের দিকে তো বেশ অসুস্থ হতাম। তখন সারা সন্ধ্যা আব্বাসী ভাই আমার পাশে বসে থাকত। যত্ন নিত। দেখা যেত, ভাবিও একসময় চলে এসেছে।
আমার ব্যাপারে আব্বাসী ভাই খুব উদ্বিগ্ন থাকত। ছোটবেলায় সে কোনো ব্যথা দিয়েছিল, কপালে হয়তো তার দাগ রয়ে গেছে বা হাতের আঙুলটা সামান্য বাঁকা হয়ে আছে। বড় হয়েও যখন ওকে মনে করিয়ে দিতাম, তার চোখে পানি এসে যেত।
মানুষ হিসেবে আব্বাসী ভাই ছিল অতুলনীয়। অসুখ হওয়ার আগপর্যন্ত সারা জীবন বাজারসদাই আমি নিজেই করতাম। বাজারে গেলে দোকানদারেরা বলত, ‘আব্বাসী সাহেব আপনার ভাই হয় না? ওনার মতো মানুষ হয় না।’ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার।
সংগীতশিল্পী হিসেবে আব্বাসী ভাইয়ের কোনো তুলনা ছিল না। যে উপলব্ধি নিয়ে সে গান গাইত, সে রকম শিল্পী এখন হয় না। আমি গায়কির কথা বলছি না। বলছি গানের ভাব নিজের মধ্যে উপলব্ধি করার ব্যাপারটা নিয়ে। অনেক ভালো শিল্পী ছিলেন বা আছেন, কিন্তু আব্বাসী ভাই গানটা বুঝে, নিজের অন্তরে ধারণ করে, মননে নিয়ে গাইত। এটা আমি একজন সংগীত সমালোচক হিসেবে বলছি, ভাই হিসেবে নয়। লোকগানে আব্বাসী ভাই অনন্য।