গতকাল বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজার আগে পরিবারের পক্ষে কথা বলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর নাতি আলভী আশরাফ। তিনি বলেন, সবার কাছে তাঁর নানা খ্যাতিমান শিল্পী হলেও তাঁর কাছে ছিলেন ভাই ও বন্ধুর মতো।
জানাজার পর মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে, যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন বাবা কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও মা লুত্ফুন্নেসা আব্বাস। মা-বাবার কবরেই দাফন করা হয় বরেণ্য এই শিল্পীকে। এ সময় শ্রদ্ধা জানাতে এসে কালের কণ্ঠকে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘মুস্তাফা জামান আব্বাসী শুধু একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না, তিনি লোকসংগীতের সংগ্রাহক, গবেষক ও লেখক ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার শোক : মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোকবার্তায় তিনি বলেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী শিল্পী বাংলাদেশের সংগীতজগতে যে অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীত পরিবারে জন্ম নেওয়া বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পীর গান ও গবেষণা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিত্যনতুন চিন্তা ও সৃষ্টির খোরাক জোগাবে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মৃত্যুতে আরো শোক প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
শিল্পীর জীবনকথা : বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মুস্তাফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা আব্বাসউদ্দীন আহমেদ ছিলেন পল্লীগীতির অগ্রপথিক। পিতা আব্বাসউদ্দীনের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সংগীত ও ধর্মীয় চেতনার দীক্ষা। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির জনপ্রিয় শিল্পী। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর বড় ভাই মোস্তফা কামাল ছিলেন প্রধান বিচারপতি। বোন ফেরদৌসী রহমান ও ভাতিজি নাশিদ কামালও সংগীতভুবনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান শিল্পী। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী আসমা আব্বাসী ছিলেন প্রথিতযশা শিক্ষক ও লেখিকা।
১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের কোচবিহারের বলরামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া মুস্তাফা জামান আব্বাসীর শৈশব কেটেছে কলকাতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
লোকসংগীত গবেষণা ও সংগ্রহে আব্বাসীর রয়েছে অনন্য অবদান। তিনি দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে কয়েক হাজার লোকগান। তিনি ২৫টির বেশি দেশে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও নজরুলসংগীত পরিবেশন করে বাংলাদেশের সংগীতকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে। তিনি ছিলেন ইউনেসকোর বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতি, নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের ইংরেজি জীবনী লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত গবেষক। তাঁর উপস্থাপনায় বিটিভির ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘আপন ভুবন’ প্রভৃতি অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পায়। সমাজসেবায়ও তিনি ছিলেন সক্রিয়, রোটারি ক্লাবের গভর্নর হিসেবে বহু উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘লোকসঙ্গীতের ইতিহাস’, ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’, ‘রুমির অলৌকিক বাগান’, উপন্যাস ‘হরিণাক্ষি’, স্মৃতিকথা ‘স্বপ্নরা থাকে স্বপ্নের ওধারে’ এবং ইংরেজি জীবনী। নবীকে ভালোবেসে লিখেছেন ‘মুহাম্মদের নাম’ শিরোনামের গ্রন্থ। সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৫ সালে একুশে পদক অর্জন করেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী।