• শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ০৮:৫৯ অপরাহ্ন

মধ্যযুগের গীতি কবিতা

নিজস্ব প্রতিবেদক / ১১৫ টাইম ভিউ
আপডেটঃ রবিবার, ৪ মে, ২০২৫
Promi News BD

এর আগের পর্বের বিষয় বস্তু ছিল বাংলা সাহত্যের প্রাচীন যুগ।সঙ্গত কারনেই তাই এই পর্ব হবে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগকে নিয়ে।তবে মধ্যযুগে যাওয়ার আগে বাংলা ভাষা ও লিপির ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা শ্রেয়তর মনে করছি।

ভাষাঃ

ভাষা হল মানুষের মুখে উচ্চারিত অর্থবোধক ও মনোভাব প্রকাশক ধ্বনি সমষ্টির সমন্বয়।

বাংলা ভাষার ইতিহাসঃ

বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক।ভাষা কোন আলৌকিক বস্তু নয় বরং এটি হচ্ছে বিবর্তনের ফসল।আর্যরা যখন অনার্যদের আক্রমণ করে এদেশে বসবাস শুরু করে তখন আর্য ভাষা হতে বিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।আর্যদের প্রাচীন ভাষার নাম ছিল বৈদিক ভাষা।সংস্কারের পরে এর নাম হয় সংস্কৃত ভাষা।তাই অনেকে বলে থাকেন যে সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতগণ তা মেনে নেন নি।কারন সংস্কৃত ভাষায় শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরা কথা বলত। সাধারন মানুষ কথা বলত “প্রাকৃত ভাষায়”। প্রাকৃত ভাষা থেকে সৃষ্টি হয় পালি ও অপভ্রংশ ভাষা। এভাবে বাঙ্গালিও যেমন সংকর জাতি তেমনি আমাদের ভাষাও বহু ভাষার সমন্বয়ে সংকরিত হয়ে বাংলা রুপ লাভ করেছে।

বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন__ “ খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়িয় প্রাকৃতের পরবর্তী গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে।

ডঃ সুনীতিকুমারের মতে__ “খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে”।

বর্তমানে বিশ্বে ৬০-৭০টি প্রভাবশালী ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম।ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থে বাংলা পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম ভাশা।আর অফিশিয়াল বা দপ্তরিক ভাষা হিসেবা বাংলা অবস্থান দশম।

পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষাগোষ্ঠী হল ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী।এর ২টি শাখা হল

১)কেন্তম

২)শতম

বলা হয়ে থাকে যে শতম শাখা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।

বাংলা লিপিঃ

ভারতীয় লিপিমালা দুই ভাগে বিভক্ত। __

১)ব্রাহ্মী লিপিঃ এই লিপি থেকে বাংলা লিপির উৎপত্তি হয়েছে।এর বিশেষত্ব হল এই লিপি বাম দিক থেকে লেখা হয়।

২)খরোষ্ঠী লিপিঃ এই লিপি ডান দিক থেকে লেখা হয়।যেমনঃ আরবী,ফারসি ইত্যাদি।

• বাংলা বর্ণমালার গঠনকাজ শুরু সেন যুগে এবং তা স্থায়ী রুপ লাভ করে পাঠান যুগে।

• বাংলালিপির স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে মনিপুরী,উড়িয়া,মৈথিলী,অসমীয়া প্রভৃতি ভাষাতে।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ ছিল ধর্মকেন্দ্রিক।অর্থাৎ ধর্মীয় আবেশে মধ্যযুগে সাহিত্য রচনা হত।

১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে ধরা হয়। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কতৃক নদীয়া বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়।

আবার মুধ্যযুগের ১২০১-১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে ভাষাবিজ্ঞানীরা অন্ধকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।কারন এ যুগে রামাই “পণ্ডিত কতৃক” ‘শূন্যপুরাণ’ এবং হলায়ুধ মিশ্র কতৃক “সেক শুভোদয়া” ছাড়া তেমন কোন প্রধান সাহিত্য রচিত হয় নি।

সাহিত্যকর্মঃ

ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্মের এই যুগে মূলত দেব-দেবীর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়েছে,তবে মানুষের কথাও অস্বীকৃত হয় নি।সাহিত্য ছিল প্রধানত পদ্য ও গীতি নির্ভর।গদ্য সাহিত্য তখনও প্রসারিত ও পরিচিতি পায় নি।

অন্ধকার যুগ পরবর্তী মধ্যযুগের সাহিত্য কর্ম গুলোকে ভাষাবিদেরা দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।তা হল__

১) মৌলিক সাহিত্যঃ

মৌলিক সাহিত্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ______ শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন,বৈষ্ণব পদাবলী,মঙ্গল কাব্য।

২) অনুবাদ সাহিত্যঃ

উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ___ রামায়ণ,মহাভারত,ভগবত ইত্যাদি।

*শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনঃ

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন হচ্ছে মধ্যযুগের আদি নিদর্শন।এটি সর্বজন স্বীকৃত ও খাঁটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

বিষয়ঃ

এটি মুলত রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যান।রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা অত্যন্ত আকর্ষনীয় ভাবে চিত্রিত হয়েছে এই সাহিত্যকর্মে।

রচয়িতাঃ

কাব্য পুঁথিটির রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস।তিনি মধ্যযুগের আদি কবি।এটি বাংলা ভাষায় রচিত কোন লেখকের প্রথম একক গ্রন্থ।গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

আবিষ্কারঃ

১৯০৯ সালে বাংলা ১৩১৬ বঙ্গাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিলা গ্রামে এক গৃহস্ত বাড়ির গোয়ালঘর থেকে পুঁথি আকারে অযত্নে রক্ষিত এ কাব্য আবিষ্কার করেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ।গৃহস্তের নাম ছিল দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

নামকরণঃ

পুঁথিতে প্রাপ্ত একটি চিরকুত অনুসারে এই কাব্যের প্রকৃত নাম হল “শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ”।

কিন্তু সম্পাদক কাব্যে কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত বিষয়বস্তু দেখে নামকরণ করেন “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন”।তাঁর বক্তব্য ছিল,

“পুথির আদ্যন্তহীন খণ্ডিতাংশে কবির দেশকালাদির কথা দূরে থাকুক, পুথির নাম পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। কথিত হয়, চণ্ডীদাস কৃষ্ণকীর্তন কাব্য রচনা করেন। খেতরীর এক বার্ষিক উৎসবে চণ্ডীদাসের কৃষ্ণলীলা গীত হইয়াছিল, অবশ্য কীর্তনাঙ্গে। আলোচ্য পুথির প্রতিপাদ্য যে শ্রীকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, তাহাতে তর্কের অবসর নাই। অতএব গ্রন্থের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামকরণ অসমীচীন নয়।’’

আবার ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার বলেছেন “ কীর্তন শব্দের অর্থ হচ্ছে কীর্তি,খ্যাতি ও যশ বিষয়ক স্তুতি গান।আবার কৃষ্ণের চরিত্রের মধ্যে প্রেমের কোন সম্বন্ধই নাই;সে শুধু আত্মতৃপ্তি চায়,সে নায়িকাকে শুধু গালাগালি করে না,ফৌজদারী মোকর্দমার আসামীর মত মায়ের বকুনি খাইয়া নায়িকার নামে কুৎসা রটনা করে,তাহার মনে দয়া নাই,মায়া নাই,সে বহুবার নায়িকাকে উপভোগ করিয়াও তাহার দোষত্রুটিই শেষ পর্যন্ত মনে রাখে এবং সে জন্য তাহাকে পরিত্যাগ করে।তাই এর নামও রাধাকৃষ্ণ ধামালী বলিলে অধিকতর সঙ্গত হয়।

ডঃ আহমদ শরীফ এই কাব্যকে শ্রীকৃষ্ণ ধামালি নামে অভিহিত করেন।।

কালিদাস রায় বলেছেন, বলপ্র্যোগ,ভয়প্রদর্শন,গ্রাম্য ভাষা প্রয়োগ,বর্বরোচিত আচরণের সমাবেশে আলংকরিক বিচারে এই কাব্যে রসাভাস ঘটেছে।

গোপাল হালদার বলেছেন ‘শ্রীকৃষ্ণ যতই আপনার দেবত্বের বড়াই করুক সে ধূর্ত এক গ্রাম্য লম্পট ছাড়া আর কিছুই নয়।’

প্রকাশকালঃ

১৯১৬ সাল বাংলা ১৩২৩ বঙ্গাব্দএ কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ এটি প্রকাশ করেন।

পুথিকাব্যটির প্রথম ২-১টি পাতা এবং শেষের পাতা পাওয়া যায় নি।

উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ

রাধা-প্রাণীকূল বা জীবাত্মা

কৃষ্ণ- ঈশ্বর বা পরমাত্মা

বড়ায়ী-প্রেমের দূতী বা অনুঘটক

কাহিনী সংক্ষেপঃ

কৃষ্ণের জন্ম, বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং পরিশেষে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট ১৩ খণ্ডে বিভক্ত।

চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির পথ সুগম হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন,

“ জয়দেব ও ভারতচন্দ্রকে বাদ দিলে এ ধরণের কাব্য সমগ্র পূর্বভারতেই আর পাওয়া যাবে না।… বোধ হয় সেকালের শ্রোতারা এই পাঁচালি গানে বাস্তবতার সঙ্গে কিছু অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনাও লাভ করত। কিন্তু আধুনিক কালের পাঠক এ কাব্যের প্রত্যক্ষ আবরণ অধিকতর আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করবেন। রাধাকৃষ্ণলীলায় কিছু উত্তাপ ছিল, জয়দেবের গীতগোবিন্দে সেই উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, সে উত্তাপ ‘অভিনব জয়দেব’ বিদ্যাপতির পদেও কিছু স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করেছে। ভারতচন্দ্র সেই উত্তাপকে কামনার পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে নর-নারীর প্রণয়চর্চাকে আলোকিত করেছেন। দেহের এই রহস্য চৈতন্য ও উত্তর-চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতে উত্তাপ হারিয়ে স্থির দীপশিখায় পরিণত হয়েছে।

সংক্ষেপে____

”রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ই ঈশ্বরের ইচ্ছায় জন্মগ্রহণ করে।রাধা ছিলেন পরমাসুন্দরী ও বালিকা বয়সেই বিবাহিতা।রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের মামি।তথাপি কৃষ্ণ রাধার সৌন্দর্যে দিওয়ানা হয়ে হয়ে পরে।পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে বেমালুম ভুলে যায়।রাধাকে পাওয়ার জন্য সে অধীর হয়ে উঠে।আর এক্ষেত্রে প্রেমের দুতী হিসেবে কাজ করে বড়ায়ি।বড়ায়ি ছিল রাধার স্বামীর বৃদ্ধা পিসি।রাধা মথুরাতে দই-দুধ বিক্রি করতে যায়। বড়ায়ি তাঁর সঙ্গে যায়। বৃদ্ধা বড়ায়ি পথে রাধাকে হারিয়ে ফেলে এবং রাধার রূপের বর্ণনা দিয়ে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করে, এমন রূপসীকে সে দেখেছে কিনা। এই রূপের বর্ণনা শুনে রাধার প্রতি কৃষ্ণ পূর্বরাগ অনুভব করে। সে বড়ায়িকে বুঝিয়ে রাধার জন্য পান ও ফুলের উপহারসহ প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু বিবাহিতা রাধা সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।বিভিন্ন কৌশলে রাধাকে পটানোর চেষ্টা করে কৃষ্ণ।কিন্তু কোনটাই যখন কাজ না করে তখন সে জোর জবরদস্তি শুরু করে।তাই ঘাট পারাপারের জন্য শুল্ক প্রদানে ব্যর্থ রাধার সতীত্ব সে জবরদস্তিমূলক হনন করে।চরিত্রহীন কৃষ্ণ শুধু রাধাকে নয় তার সখীদেরও পাণি হনন করত।অবশেষে কৃষ্ণ রাধাকে ফেলে মথুরায় চলে যায়।অন্যদিকে কৃষ্ণ বিরহে কাতর রাধা তখন মৃতপ্রায়।”

আগের পোস্টঃবাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১

তথ্যসূত্রঃ

১)শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

২)শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

৩)বাংলা ভাষা ও সাহিত্য__ ডঃ সৌমিত্র শেখর


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এই বিভাগের আরো খবর